বাজেটে নির্বাচনী ভাবনা অর্থনীতির ক্ষতি করবে

আসন্ন নতুন বাজেটটি হবে বর্তমান সরকারের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এই বাজেটে স্বল্পকালীন নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ও রাজনৈতিক চাপে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, বাজেটে নির্বাচনী ভাবনা থাকলে এতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতাটুকু রয়েছে, তা-ও নষ্ট হবে।


এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সরকারি ব্যয় মেটাতে আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব কথা বলা হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এতে সভাপতিত্ব করেন। নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এরই অংশ হিসেবে গতকালের এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করা হয়। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এ সময় আরও সমালোচনা করে বলেন, আর্থিক নীতি ও মুদ্রানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও কমে গেছে।
অর্থমন্ত্রী এ সময় বৈদেশিক সাহায্য কম অবমুক্তি এবং মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থার কথা স্বীকার করে নেন। তিনি আরও জানান, আগামী বাজেটের আকার হবে এক লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া আত্মঘাতের শামিল। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ঠিক রাখতে অবশ্যই এ রকম ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ে উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, সরকারের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তখন নতুন টাকা ছাপাতে হয়। স্বাভাবিক কারণেই এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়ে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও ঋণবঞ্চিত থাকে ব্যক্তি খাত, বাধাপ্রাপ্ত হয় নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন। তখন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় না।
উল্লেখ্য, চলতি মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৩১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
আগামী বাজেটে পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ শতাংশ কর রহিতের দাবি জানিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘আপনি মরা মানুষের ওপর করটা রহিত করতে পারেন কি না চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’ তবে সবকিছু ছাপিয়েও ‘শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে দেশের অর্থনীতিটা ভালোর দিকে যাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন ফরাসউদ্দিন।
মূল্যস্ফীতি বিষয়ে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি, সময়ে সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছি কিন্তু এটা রোধ করতে পারিনি।’
সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সরকার সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না। সম্পদ ব্যবহারে চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার তুলনায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কম অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা এখন ভাবার সময় এসেছে।’
শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ করা উচিত। কারণ, এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অর্থের বিনিময়ে সনদ বিক্রি করছে, এটা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া নিয়ে হইচই হলেও এখন আর তা শুনি না।’
আগামী বাজেট বড় ধরনের প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
চ্যালেঞ্জের ব্যাখ্যা দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সরকারের জীবনচক্রে আগামী বাজেটটি হবে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আন্তর্জাতিক জটিল পরিস্থিতি, সামষ্টিক অর্থনীতির বিদ্যমান দুর্বলতা এবং ঘনায়মান রাজনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় নিলে অন্তত তাই মনে হয়।
দেবপ্রিয় বলেন, স্বল্পমেয়াদি নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি, না উন্নয়নের লক্ষ্যে মধ্যমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার—এ দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু সরকারের মনোযোগ থাকছে প্রথমটার দিকে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তখন এই মনোযোগ আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ সরকারের প্রথম দুই বছরে বিনিয়োগে উল্লম্ফন গতি ছিল। তৃতীয় বছরে এসে সেটা কমে এসেছে। এটাই হলো বড় সমস্যা। আর্থিক নীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে না পারা অন্যতম সমস্যা বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে একটি একটা মানসম্মত ভর্তুকি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। আর কর আদায়েও জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, বেশি মূল্য দেখিয়ে আমদানি এবং কম মূল্য দেখিয়ে রপ্তানি অর্থাৎ ‘আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের’ মাধ্যমে ১৮০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ করবঞ্চিত থাকছে সরকার। রাসায়নিক সারের দামের বিষয়টি নিয়েও বিবেচনার সময় এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়া যায় কি না, সেটা পর্যালোচনার সময় এসেছে বলে মনে করেন সাবেক ব্যাংকার মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ধর্মই হলো বছরের পর বছর লোকসান দেওয়া।’
সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর চেয়ে কৌশলগত দিকে বেশি জোর দেওয়া হবে বলে জানান। মূল্যস্ফীতি বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে রাখার চেষ্টা করা হবে। দুই অঙ্কে গেলেও এটা হবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমি তাদেরকে কোনো বিরক্ত (ডিস্টার্ব) করি না, কিন্তু কেন জানি না এর বিক্রি নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে।’
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.