উইকিলিকস-ম্যানিং, না ওবামা—আইন ভেঙেছেন কে? by মশিউল আলম

মাত্র ২৪ বছর বয়সী নিঃসঙ্গ বিষাদগ্রস্ত এক তরুণের সঙ্গে বিষম এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। তরুণের নাম ব্র্যাডলি ম্যানিং। রাষ্ট্রটি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কে! প্রায় এক বছর ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে ম্যানিংকে। তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চলেছে, এমন অভিযোগও উঠেছে।


গত জানুয়ারিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ তুলেছে, ম্যানিংয়ের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা রূঢ় ও শাস্তিমূলক। এ মাসের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২৯৫ জন আইনবিশারদ নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস পত্রিকায় এক যৌথ চিঠি প্রকাশ করেন। সে চিঠিতে বলা হয়, ম্যানিংয়ের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা মার্কিন সংবিধানের পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বজন শ্রদ্ধেয় হুইসলব্লোয়ার, যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করেছিলেন, সেই ড্যানিয়েল এলসবার্গ প্রচণ্ড প্রতিবাদের সঙ্গে সংবাদপত্রে লিখেছেন, ইরাকের আবু গারাইব কারাগারের বন্দীদের সঙ্গে যে বর্বর আচরণ করা হয়েছিল, ম্যানিংয়ের সঙ্গে ঠিক তেমন আচরণ করা হচ্ছে। ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কুয়ানটিকো মেরিন কর্পস ব্রিগেডের হাজতে ম্যানিংকে উলঙ্গ করে পেটানো হয়েছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। শেষে প্রেসিডেন্ট ওবামা পেন্টাগনকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছেন: ম্যানিংয়ের সঙ্গে আইনসম্মত ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। পেন্টাগন তাঁকে আশ্বস্ত করেছে, বন্দীর সঙ্গে কোনো বেআইনি আচরণ করা হচ্ছে না। মানে, তাঁকে ল্যাংটা করে পেটানো হচ্ছে না। কিন্তু তাঁকে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে, কারণ তাঁর আচার-আচরণ দেখে কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা হয়েছে, তিনি আত্মহত্যা করে বসতে পারেন। অবশ্য তাঁর উকিল জানাচ্ছেন, ম্যানিং ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক অব পিওর রিজন বইটি পড়ার জন্য চেয়ে পাঠিয়েছেন।
২০ এপ্রিল ম্যানিংকে হঠাৎ করে ভার্জিনিয়া থেকে কানসাসের এক কারাগারে সরিয়ে নেওয়ার কদিন পর সানফ্রানসিস্কোতে এক তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মন্তব্য করে বসলেন, ব্র্যাডলি ম্যানিং আইন ভেঙেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের পক্ষে খুবই বেমানান তাঁর এই মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজে। নাগরিকদের কেউ বলছেন, ওবামা নিজেকে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ বলে জাহির করেন, কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে অপরাধী বলা যায় না, এই প্রাথমিক ধারণাটাই তাঁর নেই। অন্যরা বলছেন, সে ধারণা ওবামার ভালোই আছে। কিন্তু ম্যানিংয়ের ব্যাপারে তিনি এতই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত যে নিজেকে সামলাতে পারেননি। মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছে তাঁর মনের কথাটি।
ব্র্যাডলি ম্যানিংকে মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করে গত বছরের মে মাসে, যখন তিনি ইরাকের বাগদাদ থেকে মাইল চল্লিশ দূরের এক মার্কিন সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেইস হ্যামার নামের ওই সামরিক ঘাঁটিতে বসে সিক্রেট ইন্টারনেট প্রটোকল রাউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে (এসআইপিআরনেট) পেন্টাগন ও স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গোপনীয় তথ্যভান্ডারে ঢোকার সুযোগ ছিল তাঁর। প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা করে সপ্তাহের প্রতিটি দিন তিনি ওসব গোপনীয় তথ্য পড়েছেন। প্রায় আট মাস এভাবে কেটেছে তাঁর। ২০১০ সালের মে মাসে আদ্রিয়ান লামো নামের এক কম্পিউটার হ্যাকার এফবিআইকে জানিয়ে দেন, ম্যানিং প্রচুর পরিমাণ গোপনীয় তথ্য পাচার করেছেন উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানিংকে গ্রেপ্তার করে ইরাক থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কুয়েতের এক মার্কিন ঘাঁটিতে। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয় জুলাই মাসে।
উইকিলিকসের পৃথিবী-কাঁপানো প্রকাশনা তৎপরতা তত দিনে শুরু হয়ে গেছে। গত বছরের ৫ এপ্রিল ওয়েবসাইটটি প্রায় ৩৯ মিনিটের এক ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায়, মার্কিন সেনারা অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে হাসাহাসি করছে। উইকিলিকস ওই ভিডিওচিত্রের নাম দিয়েছে ‘কোল্যাটারাল মার্ডার’ (আনুষঙ্গিক হত্যাযজ্ঞ), দুটি শিশু, বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একজন সাংবাদিক ও এক ক্যামেরাম্যানসহ এক ডজনের বেশি নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে মার্কিন সেনারা হত্যা করে প্রায় খেলার ছলে। তার আগে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উইকিলিকস প্রকাশ করে মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তার কিছু অংশ (নভেম্বরে প্রকাশ করা শুরু করে ব্যাপক সংখ্যায়)। যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় পেজারের মাধ্যমে বিনিময় করা গোপনীয় অনেক বার্তাও উইকিলিকস প্রকাশ করে গত বছরের মে মাসের আগে।
আদ্রিয়ান লামো দাবি করেন, ব্র্যাডলি ম্যানিং তাঁকে ইন্টারনেটে চ্যাটিংয়ের সময় জানিয়েছেন যে ম্যানিং গোপনীয় তথ্যগুলো উইকিলিকসের অ্যাসাঞ্জকে দিয়েছেন। সেই চ্যাটিংয়ের কপিও তিনি এফবিআইকে দেখিয়েছেন। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বা উইকিলিকসের কেউই অবশ্য স্বীকার করেননি যে গোপনীয় তথ্যগুলো তাঁরা ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের কাছ থেকেই পেয়েছেন। খবর পাওয়া যাচ্ছে, কারারুদ্ধ ম্যানিংয়ের কাছ থেকে এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চলছে যে তিনি গোপনীয় তথ্যগুলো চুরি করে পাচার করেছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কাছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত গোপনীয় নথিপত্র বেআইনিভাবে নিজের কম্পিউটারে কপি করে নিয়েছেন এবং অন্যত্র পাচার করেছেন। এ বছরের মার্চ মাসে তাঁর বিরুদ্ধে আরও ২২ ধরনের অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে। সেগুলোর একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শত্রুকে সহযোগিতা’ করা; এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আগের অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ৫২ বছরের কারাদণ্ড।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন থেকে শুরু করে কট্টর রিপাবলিকান নেত্রী সারাহ পেলিন পর্যন্ত—যাঁরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ঘোষণা করে আল-কায়েদার জঙ্গিদের মতো পাকড়াও করার আহ্বান জানিয়েছেন, ব্র্যাডলি ম্যানিং সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সর্বশেষ মন্তব্যটি তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পেন্টাগনের চূড়ান্ত টার্গেট জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর উইকিলিকস। ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো আদালতে সত্য বলে প্রমাণিত হলে তার সূত্র ধরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধেও এসপিওনেজ অ্যাক্টের আওতায় অভিযোগ দাঁড় করানো সম্ভব হবে। আগামী জুলাই মাসে অ্যাসাঞ্জকে সম্ভবত ব্রিটেন থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণ করা হবে। পেন্টাগন অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চায়।
ব্র্যাডলি ম্যানিং বা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ স্বীকার করুন বা না করুন, দুই লাখ ৬০ হাজার মার্কিন গোপন কূটনৈতিক তারবার্তা, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর মানবাধিকারবিরোধী তৎপরতার প্রামাণ্য নথিপত্রসহ প্রচুর পরিমাণ গোপনীয় তথ্য সারা বিশ্বের জনসাধারণের গোচরীভূত হওয়ার কৃতিত্ব এই দুই বিদ্রোহীকেই দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষ। দেশটির নাগরিকেরা বলছেন, ব্র্যাডলি ম্যানিং রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন বটে। কিন্তু তা করে তিনি কোনো অপরাধ করেননি, বরং বিরাট বড় ‘পাবলিক সার্ভিস’ করেছেন। কারণ, তিনি ওই গোপন তথ্যগুলো ফাঁস না করে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ জানতে পেত না, নির্বাচিত সরকার কী ন্যক্কারজনকভাবে তাদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে। তাঁরা বলছেন ব্র্যাডলি ম্যানিং একজন বীর, তাঁকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। ম্যানিং যুক্তরাষ্ট্রের আইন ভেঙেছেন—ওবামার এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এক মার্কিন নাগরিক ওয়েবসাইটে লিখেছেন:
‘আইন ভেঙেছে জর্জ বুশের সরকার। আইন ভেঙেছে আমেরিকার ব্যাংকগুলো ও বন্ড রেটিং এজেন্সিগুলো। আইন ভেঙেছে টেলিফোন কোম্পানিগুলো। আইন ভেঙেছে সরকারি সংস্থাগুলোর নির্যাতনকারীরা। আইন ভেঙেছে ওবামার বর্তমান সরকার। এসবের নিন্দা জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। গর্হিত বা জঘন্য (‘ভাইল’) বললে কম বলা হয়।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.