এলপি গ্যাস নিয়ে গ্রাহক প্রতারণা by অরুণ কর্মকার

সারা দেশে তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস কেনাবেচায় গ্রাহক প্রতারণা চরমে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের কাঁচামালের (এলপি মিক্স) দাম গড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ২০০ মার্কিন ডলারের বেশি কমলেও দেশের বাজারে সে অনুযায়ী দাম কমছে না।


এর পাশাপাশি সরকারি খাতের কম দামের এলপি গ্যাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রতারণার কাজে সরাসরি ব্যবহূত হচ্ছে। সাড়ে ১২ কেজি ওজনের সরকারি খাতের প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও সাধারণ গ্রাহকদের তা কিনতে হয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সিলিন্ডারের দামেই।
আন্তর্জাতিক বাজারদর: দেশে এলপি গ্যাসের বর্তমান সরবরাহের প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। তাই বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা এলপি গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের ওপর নির্ভরশীল।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে যেমন কাঁটায় কাঁটায় হিসাব করে দাম বাড়ানো হয়, দাম কমলে তা করা হয় না। বাংলাদেশে এলপি গ্যাসের কাঁচামাল সরবরাহকারী এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এলপি গ্যাস উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন সৌদি অ্যারামকো প্রতি মাসের ১ তারিখে তাদের মালিকানাধীন এলপি গ্যাসের রপ্তানিমূল্য (কন্ট্রাক্ট প্রাইস বা সিপি) ঘোষণা করে। চলতি এপ্রিল মাসে সৌদি অ্যারামকোর নির্ধারিত দাম হচ্ছে প্রতি টন প্রোপেন ৯৯০ ও বিউটেন ৯৯৫ ডলার। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যয় যোগ করলে এ মাসে সাড়ে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের দাম থাকা উচিত এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে খবর নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো কোম্পানি গত মাসের তুলনায় দাম কিছুটা কমালেও তা দেড় হাজার টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকারি গ্যাসে প্রতারণা: বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন এলপি গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা চার লাখ টনেরও বেশি। কিন্তু সরবরাহ এক লাখ ১০ হাজার টনের মতো। এর মধ্যে দেশের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র ও ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে উৎপাদিত সরকারি খাতের এলপি গ্যাসের পরিমাণ ২৫ হাজার টনের মতো।
সরকারি খাতের এই গ্যাসের প্রতিটি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারিত রয়েছে ৭০০ টাকা। কিন্তু কিছু সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া সাধারণ গ্রাহক এই দামে কখনোই সরকারি এলপি গ্যাস পান না। সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারি খাতের কিছু গ্যাস জেলা পর্যায়ে সরকারি কর্মকতাদের দেওয়া হয়। বাকি সিলিন্ডারগুলো সাধারণ গ্রাহকদের কিনতে হয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সিলিন্ডারের কাছাকাছি দামেই।
গ্যাস-সংযোগ বন্ধের প্রতিক্রিয়া: প্রায় দুই বছর ধরে সরকার গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখায় ঢাকাসহ সারা দেশের শহরাঞ্চলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এলপি গ্যাস। কোনো বিকল্প জ্বালানি না থাকায় এর চাহিদা বাড়ছে হু হু করে। এলপি গ্যাসের শিল্প ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত এক বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে এলপি গ্যাসের বিপণনকেন্দ্র বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। আমদানিও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
সরকার এই চাহিদার কথা বিবেচনা করে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারজাত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে নতুন কয়েকটি কারখানা স্থাপন, গ্রাহকের কাছে এলপি গ্যাস সহজলভ্য করা এবং ভর্তুকি দিয়ে হলেও দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিল। কিন্তু বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রভাবে সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না বলে সরকারি সূত্র জানায়।
এ কারণে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে জ্বালানি ব্যবহারে নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। যাঁরা পাইপলাইন গ্যাসের সংযোগের আওতায় আছেন, তাঁদের প্রতি মাসে জ্বালানি খরচ সর্বোচ্চ সাড়ে ৪০০ টাকা। আর যাঁদের এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে হয়, তাঁদের খরচ মাসে তিন হাজার টাকারও বেশি।
এই বৈষম্যমূলক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানিসম্পদ গ্যাস পাইপলাইনে সরবরাহ ও ব্যবহারে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে চলেছে। পেট্রোবাংলা বিশেষ টাক্সফোর্স মাঠে নামিয়েও এই অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে পারছে না।

No comments

Powered by Blogger.