পিঠা, পরিবার এবং স্বপ্নের কথা by তৌহিদা শিরোপা

মা পিঠা তৈরি করেন। সেই আয়ে ছেলেরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। যখন মায়ের কাছেপিঠার চাহিদা বেশিআসে তখন ছেলেরাও সাহায্য করেন মাকে... ঢাকার মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ছোট্ট বাসাতে প্রায়ই পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। মা একা না পারলে ছেলেরা বানানো শুরু করেন।


স্বামী পাশে বসে উৎসাহ দেন। রাতভর চলে পিঠা বানানো। তবে নিজেদের জন্য নয়, এই পিঠা বিক্রির আয় থেকেই তো ছেলেরা লেখাপড়া শিখছেন। এটি নার্গিস সুলতানার পরিবারের গল্প। পিঠার অর্ডার এলে নার্গিস সুলতানার দম ফেলার সময় থাকে না। ‘শীতকালে বা যেকোনো উৎসবের আগে বেশি চাহিদা থাকে। আর সারা বছর তো কম-বেশি অর্ডার থাকেই। মজার কথা হলো, আমি বিয়ের আগে তেমন কোনো রান্না জানতাম না। পিঠাও বানাতে পারতাম না। তবে ছোট থেকে আমাদের দেশের বাড়ি মাগুরায় দাদি, নানি ও মাকে দেখেছি নানা ধরনের পিঠা তৈরি করতে। বিয়ের পর সংসারের সব কাজের সঙ্গে রান্নাও ভালোভাবে শিখে ফেললাম। আত্মীয়স্বজন আমার হাতের পিঠার খুব প্রশংসা করত। প্রশংসা পেয়ে উৎসাহ পেলাম। স্বামী ও দুই ছেলেকে বললাম, পিঠা বানিয়ে বিক্রি করলে কেমন হয়? সংসারেও একটু সচ্ছলতা আসবে। সন্তানদের ঠিকভাবে পড়াশোনা করাতে পারব। একটু দ্বিধা কাজ করছিল সবার মধ্যে। লোকে কী বলবে? অনেক ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এ বিষয়ে আমার স্বামীর চাচাতো ভাইয়েরা খুব সাহায্য করলেন। তাঁদের একটি ফাস্টফুডের দোকান আছে। সেখানে পিঠা বানিয়ে দিতে লাগলাম। সেই ২০০৭ সাল থেকে আজও চলছে পিঠা বানানো।’ বলেন নার্গিস সুলতানা।
সাধারণত পুলিপিঠা বেশি বানান তিনি। তবে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী সব ধরনের পিঠা তৈরি করে থাকেন। কখনো কখনো এক ঘণ্টায় ১০০ পিঠা বানাতে হয়। বাসি পিঠা বিক্রি তো করেনই না, এমনকি কোনো উপকরণ, বিশেষ করে নারকেল আগে থেকে কোরানো থাকলেও সেটি ব্যবহার করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষকে ঠকিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। গুণগত মান ঠিক রাখতে হবে। নার্গিস সুলতানা বলেন, ‘কখনো ভেজাল দিলে বা বাসি উপকরণ দিলে তো আমার সুনাম নষ্ট হবে। নিজের সুনাম কে নষ্ট করতে চায়? ২০০-৩০০ পিঠা একাই তৈরি করতে পারি। এর বেশি অর্ডার এলে ছেলেরা সাহায্য করে। ছোট ছেলে তো দ্রুত বানাতে পারে। ও ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। আর বড় ছেলে লেখাপড়া শেষ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছে। ওরা জানে, পিঠা বানিয়েই ওদের লেখাপড়া শিখিয়েছি। বাড়তি কোনো লোকবল নেই আমার। সব নিজেকেই করতে হয়। আমার এক ভাবি আছেন, তিনি মাঝেমধ্যে এসে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।’
নিজে কোনো পিঠা খেতে পছন্দ করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে হেসে বলেন, ‘সবই ভালো লাগে। পুলিপিঠা বেশি ভালো লাগে। অন্যের পছন্দই আমার পছন্দ। তবে আমার দুই ছেলের পছন্দ ভিন্ন ভিন্ন। বড় ছেলে তেলে ভাজা পিঠা খেতে পছন্দ করে। আর ছোটটা পুলিপিঠা, তবে পিঠা খেয়ে ওদের চোখেমুখে তৃপ্তি দেখলে আর আমার কিছু লাগে না।’
প্রায়ই এমন হয়, কোথাও হয়তো সবাই মিলে বেড়াতে গেছেন নার্গিস সুলতানা। হঠাৎ কোনো ফোন এল আজই পিঠা বানিয়ে দিতে হবে। বেড়ানো ফেলে সবাই মিলে বাসায় ফিরে পিঠা বানানো শুরু। এখন এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ‘আমার হাতের পিঠা খেয়ে অনেকে প্রশংসা করেছেন। তবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান কোনো এক অনুষ্ঠানে আমার বানানো পিঠা খেয়ে খুব প্রশংসা করেন। এটি শুনে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছি। কোনো কাজই আসলে ছোট নয়।’
নার্গিস সুলতানার এখন ইচ্ছা ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া নেওয়ার। সেখানে থাকবে রকমারি পিঠা। তাঁর সঙ্গে আরও নারীরা কাজ করবেন। নিজের অজান্তেই বদলে যায় নার্গিস সুলতানার দৃষ্টি। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দুচোখ, যেন সেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বপ্ন আর স্বপ্ন...

No comments

Powered by Blogger.