দাদার জন্য সত্তুর লাখ! by ফজলুল বারী

আমাদের দাদা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কেন মন্ত্রী করা হচ্ছিল না, তা নিয়ে অনেকদিন শেখ হাসিনার সমালোচনা করে লিখেছি। মনে হয়েছে দাদার মতো অভিজ্ঞ লোকজনের মন্ত্রিসভায় থাকা দরকার। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা তাকে আর ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রী করেছেনও।

কিন্তু সর্বশেষ সত্তুর লাখ টাকার বিষয় নিয়ে যে কেলেংকারি ধরা পড়ল, এরসঙ্গে জড়ালো বিজেবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত! বাংলাদেশের প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ চলতো তাহলে টেলিফোন রেকর্ড থেকে এই সময়ে পুরো বিষয়টি নিয়ে কোথায় কার সঙ্গে কী আলাপ হয়েছে তা জানা যেত। অনেকগুলো পত্রিকায়, অনলাইনে এসবের বৃত্তান্ত পড়ে এর সঙ্গে দাদার বক্তব্যের হেরফের দেখে-জেনে লজ্জিত হয়েছি! যে যাই বলুন না কেন, এটি কিন্তু এ সরকারের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে চিহ্নিত হবে। বিএনপি আমলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত নির্বাচনে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। তারেক-কোকোর দুর্নীতির মামলা যত এগোচ্ছে, তত মরিয়া ভূমিকা নিচ্ছে বিএনপি। এর মধ্যে ধরা পড়লো সত্তুর লাখ টাকার বখরা ভাগাভাগির কেলেংকারি! সামনে ঢাকা সিটির নির্বাচন। এখন কিন্তু এ টাকার বিষয়টি আগামীতে সরকারকে অনেক ভোগাবে! শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য আর কী!
সোমবার মধ্যরাতের গাড়ি-টাকা বৃত্তান্ত, মঙ্গলবার সারাদিন ঢাকা-চট্টগ্রামে মিডিয়ার লোকজনের অনুসন্ধানে যা বেরিয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে! টাকার ভাগ দিতে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে ঢাকা সফরে এসেছিলেন! সঙ্গে তার নিরাপত্তা দেখার জন্য এনামুল নামের একজন ছিল। এরপর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের নেতৃ্ত্বে তারা রওয়ানা হন মন্ত্রীর বাড়ি। পথে বখরার ভাগ চেয়ে বসে বেয়াদব(!) গাড়িচালক মো আজম! এপিএস এতে ক্ষেপে গিয়ে তার সঙ্গে শাসানির আচরণ করেন। চালক তখন শোধ নিতে অথবা জব্দ করতে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয় পিলখানার ভেতরে। তার চিল্লাচিল্লিতে বিজেবির লোকজন তাদের আটক করতে গেলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল! এরপর আবার এটিএনের বেরসিক রিপোর্টার টেলিফোনে গাড়িচালক আজমের ইন্টারভ্যু করে ফেললে গোঁমর আরও ফাঁস হয়। ওই ব্যাটা এটিএনকে বলে ফেলে যে মন্ত্রীর এপিএস তার সঙ্গে ৩০ লাখ টাকায় দফারফা করতে চেয়েছে! এখন নানাভাবে টাকার নানা অংক বলা হচ্ছে! মন্ত্রীর এপিএস বলছে ২৫-৩০ লাখ! লন্ডন থেকে নাকি তার শালা পাঠিয়েছে!

রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা বলছেন, নতুন ট্রেনের শায়েস্তাগঞ্জ স্টপেজ নিয়ে তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তিনি মন্ত্রীর বাসা চেনেন না তাই এপিএস নিয়ে যাচ্ছিলেন! রেলওয়ের সচিব আছেন, নানা কর্তা ব্যক্তিরা আছেন, আর তাদের ডিঙিয়ে মহাব্যবস্থাপক রাতের বেলা চলে যাচ্ছিলেন মন্ত্রীর বাড়ি! কী কর্তব্যপরায়ণ এই কর্মকর্তা! মঙ্গলবার এ ব্যাপারে মিডিয়া ব্রিফিং করতে গিয়েও তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন আমাদের দাদা! কালের কণ্ঠের রিপোর্ট অনুসারে সংবাদ সম্মেলনে এসেই মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশংসা করতে থাকেন। তিনি বলেন, ভারতের মিডিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া ভালো। এই আলোচনা তুলে হাসতে হাসতেই মমতা ব্যানার্জি, বিপিন পালের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজ কণ্ঠস্বরে আবৃত্তির ধরন, সিরাজউদ্দোলা, মীর জাফর, বাঙ্গালি চরিত্র এসব নিয়ে ১টা ১৬ থেকে টানা ১৪ মিনিট বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি মন্ত্রী হবার পর এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কী কী করবেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন। কিন্তু সাংবাদিকরা তো তার কাছে গিয়েছিলেন সত্তুর লাখ টাকার কাহিনী জানতে। মন্ত্রী বলেন, ওই ড্রাইভার মাদকাসক্ত। তিনি শুনেছেন, ড্রাইভার তার এপিএসকে অপহরণ করতে চেয়েছিল। গাড়িতে আরও দু’জন লোক ছিল। ওই টাকা এপিএসের ব্যক্তিগত টাকা। তার কাজ শেষে এপিএস কোথায় যায়, কি করে এসব তার দেখার বিষয় না। বাংলাদেশের আইনে যার যার টাকা বহনের অধিকার আছে, কাউকে আটক করার বিষয়টি ঠিক না, মহাব্যবস্থাপক আর তার এপিএস এই সময়ে অফিস করবেন ইত্যাদি।

এরপর আমাদের সুরঞ্জিত দাদা বলেছেন, তিনি দুটি তদন্ত কমিটি করেছেন। কমিটি দুটি ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। তিনি তদন্ত কমিটি করেছেন, তদন্ত আর রিপোর্ট দেবার আগেই বলে ফেলেছেন ঘটনার বিস্তারিত! তাহলে তো খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠবে যিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন, তিনিই বলে দিয়েছেন ঘটনার বৃত্তান্ত, তাহলে আর তদন্তের কী দরকার? মন্ত্রীর অধীনস্তরা কি মন্ত্রীর বক্তব্যের বাইরে যাবেন? বা যেতে পারবেন? তাদেরও তো ঘাড়ে মস্তকের সংখ্যা একটি, তাই নয় কি? বা এমন তদন্তের আগেই তদন্তের বিষয় নিয়ে বলে ফেলার বাজে প্রভাব সম্পর্কে সুরঞ্জিত বাবুই কি জীবনে বহুবার বলেননি? এভাবে বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের দাদা নিয়োগ বাণিজ্য আর বস্তাভর্তি টাকার দায়দায়িত্ব কিন্তু নিজের কাঁধে নিজেই নিয়ে নিয়েছেন। তিনি আর এখান থেকে বেরুতে পারবেন না। এখন এ পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া-প্রতিকারই বা কী? প্রতিক্রিয়া হবে সরকার যে তারেকের বিদেশে টাকা পাচারের ডকুমেন্টারি প্রমাণ হাতে পেয়ে সে বিচার শুরু করেছে, সে বিচারের নৈতিক জায়গাটিতে সরকার দুর্বল হয়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে সরকারের ইমেজে-কাজেকর্মে।

প্রতিকারটা কী? এরও সহজ কোনো উত্তর নেই। সরকারকে এর ঘোরতর বিপদ থেকে রক্ষা পেতে প্রথম করণীয় জরুরি কাজটি হলো, সুরঞ্জিত বাবুর পদত্যাগ করে চলে যাওয়া অথবা প্রধানমন্ত্রীর তাকে বরখাস্ত করা। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো এর একটিও ঘটবে না। এদেশের দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে কোনোদিন কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগের দৃষ্টান্ত নেই। প্রধানমন্ত্রীও মনে করবেন, দুর্নীতি স্বীকার করলে তাতে তার সরকারের ইজ্জত যাবে! বিষফোঁড়া যে প্রয়োজনে অপসারণ করে ফেলে দিতে হয়, তা আমাদের নেতারা তালগাছটা নিজেদের হলে তা আর মানেন না অথবা মানতে চান না। পরে তা রূপ নেয় ক্যান্সারে। বাংলাদেশ বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছে এমন ক্যান্সারের অভিশাপ। হায় দাদা, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে তার দীর্ঘ ঐতিহ্যের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটি এই বুড়ো বয়সে এসে এভাবে পোতায়া যাচ্ছে পঙ্কিলে!

No comments

Powered by Blogger.