যুদ্ধাপরাধ : ন্যুরেমবার্গ থেকে ঢাকা by এস. এম. আব্রাহাম লিংকন

গত ২৯ মার্চ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি আদেশকে তাঁর আইনজীবী মিজানুল হক 'পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন জংলি ও জঘন্যতম আদেশ' বলেছেন (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম ৩০.৩.২০১২)। এ ধরনের নোংরা বিবৃতি যে আদালতে বিচার হচ্ছে তার ভাবমূর্তি যেমন বিনষ্ট


করছে, একই সঙ্গে বিবৃতিটি আদালত অবমাননার শামিল। এসব বিবৃতি সব সময়ই আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা আদালতের ওপর সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ তৈরির কূটকৌশল থেকেই সৃজিত হয়। মনে রাখতে হবে, এ আদালত আইনের নিরিখেই সৃষ্টি; এতে হয়তো জনগণের সমর্থন আছে কিন্তু জনগণের সব ইচ্ছার প্রতিফলন এখানে নেই। আমাদের প্রচলিত বিচার পদ্ধতির প্রতি জনগণের বেশ অনাস্থা আছে তার দীর্ঘসূত্রতার কারণে। যে পরিমাণ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিচারপ্রার্থীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে সেখানে সংক্ষিপ্ত বিচারই জনগণের কাছে শ্রেয় ছিল। সরকার বা সংসদ তা চায়নি বলেই বর্তমান পদ্ধতিতে এ প্রলম্বিত বিচার। হয়তো সরকারের এ উদ্দেশ্য ছিল যে সংক্ষিপ্ত বিচারে জনগণের বিচার অবলোকন করার সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ সংক্ষিপ্ত বিচার অনেকটাই ইমপোজিং বা আরোপিত। বর্তমান বিচার আদালত আন্তর্জাতিকমানের। আমরা আন্তর্জাতিক পরিধিতে এ পর্যন্ত যেসব আইন ও আদালত দেখেছি, তার চেয়ে আমাদের দেশজ আইনে গঠিত এ আন্তর্জাতিক আদালত অনেক নমনীয়, অনেক প্রগতিশীল। এখানে আপিলের অধিকার আছে, আছে জামিনের অধিকার। এমনকি আমাদের জেলকোডে সীমাবদ্ধতা থাকলেও গোলাম আযমের মতো স্বীকৃত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জেলে থেকে বাড়ির ভাত খায় কিভাবে? তার পরও আসামিপক্ষের নিযুক্ত কৌঁসুলির আদালতের গায়ে কাঁদা লেপনের চেষ্টা আদালত অবমাননারই শামিল।
১৯৪৪ সালের ৬ জুন হিটলার তাঁর গোপন মারণাস্ত্র V-1 এবং সেপ্টেম্বরেV-২ বোমা দুই দফায় বর্ষণ করে দুই হাজারের বেশি লন্ডনবাসীকে হত্যা করেন। এ দুই হাজার নাগরিকের প্রাণহানি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে ব্যথিত করে, সে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি তাঁর পূর্বোক্ত মত পরিবর্তন করে বলেছিলেন, 'নাজিরা বিচারের আশা করতে পারে না। বিচারের অধিকার তাদের নেই। সংক্ষিপ্ত শুনানি শেষে তাদের উন্মুক্ত স্থানে টেনে এনে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারতে হবে।' মাত্র দুই হাজারের অধিক মানুষের প্রাণহানির কারণে এ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উইনস্টন চার্চিলের। আমেরিকার প্রেসিডেস্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে তাঁর কেবিনেটের ট্রেজারি সেক্রেটারি হেনরি মরজেনদ্যান বোঝাতে সক্ষম হন, 'জনগণ নাজি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। তারা প্রতিশোধ চায়। বিচার হচ্ছে একটি দীর্ঘ বিরক্তিকর প্রক্রিয়া।' অতঃপর রুজভেল্ট চার্চিল এর মত গ্রহণ করেন। রুজভেল্ট ও চার্চিল কুইবেক বৈঠকে একমত হন যে নাৎসিদের বিচার পাওয়ার অধিকার নেই। কোনো বিচার হবে না।' (The Road to Nuremberg by Bradly F Smith)।
তাহলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ নাগরিকের প্রাণ হরণের ক্ষেত্রে কী হওয়া উচিত ছিল? যারা ৩০ লাখ নাগরিকের মানবাধিকার দেখেনি তাদের মানবাধিকার মেনে বিচার প্রাপ্তির অধিকার দেওয়া উপরিউক্ত মত দৃষ্টে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তদুপরি রাষ্ট্র যথেষ্ট দয়াশীল হয়েছে এসব চিহ্নিত আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীর ক্ষেত্রে। বিচারে আইনের নমনীয়তা ও বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যক্রম ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। যে দু-চারজন বিরোধিতা করেছেন তাঁরা জামায়াতের লবিস্ট শ্রেণীভুক্ত, সেটিও সর্বজনবিদিত।
কেন সাঈদীর আইনজীবী এ ধরনের আদেশকে জংলি বলেছেন, কৈ তাঁরা তো একবার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননি তাঁদের অনেক দাবি আইনানুগ হওয়ায় আদালত মেনে নেওয়ায়। পৃথিবীর কোনো দেশেই যুদ্ধাপরাধীরা জামিনে নেই; অথচ জয়পুরহাটের আবদুল আলীম জামিনে আছেন। তাঁরা গোলাম আযমের জামিন চেয়েছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনাল তা নামঞ্জুর করেছেন। কারণ আছে, যেমন কারণ আছে আবদুল আলীমের জামিনের, তেমনি কারণ আছে গোলাম আযমের জামিন বাতিলের। আবদুল আলীম শুরু থেকেই অসুস্থ; পক্ষান্তরে গোলাম আযম গ্রেপ্তারের আগের দিনও বডিগার্ডসহ প্রাত্যহিক ব্যায়াম করেছেন। মাঝেমধ্যে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুকূলে নিজ অবস্থানের সাফাই গেয়েছেন। কৃতকর্মের জন্য দুঃখ বা অনুতপ্ত কোনোটি সেখানে ছিল না বরং দম্ভ ছিল অবয়বজুড়ে। আজ টেলিভিশনের সামনে তাঁকে হুইলচেয়ারে দেখা যায়; এটি অনুকম্পা পাওয়ার জন্য আরোপিত। বিচারে অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের কৌশল। এ কৌশল সবার জানা বলেই তিনি আটক। ধারণা করি, পৃথিবীতে তিনি একমাত্র যুদ্ধাপরাধী, যিনি বাড়ির খাবার খেয়ে হাজতবাস করছেন। আদালতের এ ধরনের দয়ার প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা ডিফেন্স কাউন্সিলের নেই। বরং আইনি সিদ্ধান্তকে ব্যঙ্গ করে জনগণের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
এ কথা ঠিক জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধের কারণে আটক; কিন্তু সব জামায়াত নেতা নন। যাঁরা নতুন প্রজন্ম, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, তাঁদের যুক্ত করা হয়নি। যদিও বলা হয় 'মীরজাফর' হওয়ার জন্য ১৭৫৭ সালের আগে জন্ম নেওয়ার আবশ্যকতা নেই। মীরজাফরের অনুরূপ যে আচরণ করে তার প্রকৃত নাম মীরজাফর না হলেও তাকেই জনগণ মীরজাফর বলে। তেমনি অনেক জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মী হয়তো যুদ্ধাপরাধীর মতো আচরণ করছেন, তাঁরা হয়তো আচরণগত অর্থে যুদ্ধাপরাধী, হয়তো জনগণ একই অর্থে নিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র, আইন-আদালত তাঁদের সমপর্যায়ভুক্ত করেনি। রাষ্ট্র চাইলেই জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে পারে। নিষিদ্ধ হওয়ার মতো পর্যাপ্ত অভিযোগও আছে। তার পরও দলটি এখনো নিষিদ্ধ নয়, কেন নয়, তা রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে পারবেন। তার পরও তাঁদের আইনজীবীরা দিব্যি দর্পভরে বলছেন জামায়াতের রাজনীতিকে হয়রানি করার জন্য যুদ্ধাপারধের বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। বিচারে খালাস হবে না দণ্ড হবে- তা রাষ্ট্র এখনো জানে না। এ পর্যায়েও বিচারকারী আদালতের পক্ষে সাক্ষ্য পর্যালোচনা না করে বলা সম্ভব নয়- বিচারে কে খুশি হবে- 'জনগণ' না রাষ্ট্রবিরোধীরা।
১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি আদালতকে জানিয়েছিলেন, 'তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না, বিচারের রায় আগে থেকে তৈরি আছে।' তিনি ব্রোহির মতো বিখ্যাত আইনজীবীকে উপেক্ষা করেছিলেন। নিজে থেকে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। এখানে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীরা নিজস্ব পছন্দের আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন, আদালতের অনুমতিক্রমে জেলখানায়ও বিচারের বিষয় নিয়ে আসামিদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলতে পারছেন, জেরা করছেন, বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি দিচ্ছেন। আসামিপক্ষে আদালতের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে নিশ্চয়ই বলতে পারি, এ আদালত নিরপেক্ষ ছিল, আছে এবং থাকবে। এ ধরনের মানসম্মত আদালতের ২৯.৩.২০১২ তারিখের আদেশকে ব্যঙ্গ করে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল হক যখন বলেন 'জংলি ও জঘন্যতম আদেশ', তখন সে বক্তব্যের উদ্দেশ্যকে গভীরে উপলব্ধিতে নিতে হবে।
যে সাক্ষীকে আদালতে আনা যাবে না, হাজির করা সময়সাপেক্ষ, সেসব সাক্ষীর বক্তব্যকে গ্রহণ করার বিধান সব সভ্য রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে আছে। এই উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ এ ধরনের সুযোগ সংরক্ষিত আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালও যে আদেশ দিয়েছেন, তা আইন বর্হিভূত নয়। কারণ সেটি উভয় পক্ষের যুক্তিতর্কের পর আইসিটি অ্যাক্টের ১৯(২) ধারা মতে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের ৪৬ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এও বলেছেন, তাদের 'ক্রস একজামিন জেরা' হয়নি তা বিবেচনায় রাখা হবে। রাষ্ট্র পক্ষের শাহরিয়ার কবির, ড. জাফর ইকবাল এবং জুয়েল আইচের মতো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন এমন ৩১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণের আবেদনকে ট্রাইব্যুনাল অগ্রাহ্য করেছেন। এখানে তো রাষ্ট্র অপেক্ষা ডিফেন্সের সাফল্য বেশি। তার পরও ডিফেন্সের আইনজীবীর আদালতের বিরুদ্ধে বেপরোয়া-অশ্রাব্য ভাষা আমাদের ভাষাহীন করে।
জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাকের উপস্থাপিত বক্তব্যের গতি-প্রকৃতি থেকেই দৃশ্যমান '৭১-এর যুদ্ধাপরাধে গোলাম আযম মূল ছিলেন না, ছিলেন সহযোগী। সহযোগীর বিচার হতে পারে না মূলকে বাদ দিয়ে। যেভাবেই হোক বিচারে আজ গোলাম আযম স্বীকার করেছেন তিনি সহযোগী ছিলেন মূল ছিলেন না। জনগণ ৩০ লাখ বাঙালি হত্যার বিচার চায়, কে প্রধান আসামি আর কে সহযোগী, তা বির্তকের বিষয় হতে পারে না। এখানে নিত্য জ্বালিয়েছে পাকিস্তানপ্রিয় কুলাঙ্গার গোলাম আযম, নিজামীরা। এদের দেখানো মতে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। কে হত্যা করেছে তার চেয়ে বড় কথা, আমার বাবাকে হত্যার জন্য কোন প্রতিবেশী যখন কোন খুনিকে আহ্বান করে এবং আহ্বানকারীর প্রত্যাশা মতো আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয় তখন হত্যাকারী অপেক্ষা যে হত্যার জন্য ইন্ধন জোগায় সে প্রধান হয়ে ওঠে। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তাদের দায়মুক্তি চুক্তিতে ছিল না। চুক্তিবদ্ধ পাকিস্তানের অঙ্গীকার ছিল তারা তাদের বিচার করবে। তারা করেনি, সে দায় আমাদের রাষ্ট্রের নয়, পাকিস্তানের। তাদের বিচার পাকিস্তান করেনি বলেই সেখানে আজ নিত্য খুন, নানা রঙে পাপের বিকাশ। আমাদের দেশে এমন কোনো আইন হয়নি, যে আইন দ্বারা যুদ্ধপরাধী গোলাম আযম-নিজামীদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। খুনের বিচার হতেই হবে। যে জামায়াত-শিবিরকর্মী বাংলাদেশের পক্ষে, যার জন্ম বাংলাদেশের জন্মের পর সে কেন নিজামীদের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে নেবে! হত্যার বিচারে বাধা হয়ে সে কেন নিজেকে পাপিষ্ঠ করবে? জামায়াতের নতুন প্রজন্ম কি পারে না মেরুদণ্ড সোজা করে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে?

লেখক : আইনজীবী ও সাবেক রাকসু নেতা
abrahamlincoln66@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.