অবরোধ-কিউবার অর্ধশতাব্দীর বন্দিত্ব by ফজলুল হালিম

কিউবার বিরুদ্ধে আরোপ করা যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধশতাব্দীব্যাপী বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট। কিউবায় গত ২৮ মার্চ তিন দিনের সফর শেষে ফিরে যাওয়ার সময় হাভানার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেন।


তিনি দেশটির জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। এ ছাড়া এই ধর্মগুরু কিউবার রাজধানী হাভানাতে অবস্থিত বিখ্যাত বিপ্লবী চত্বরে আয়োজিত একটি সমাবেশেও ভাষণ দেন। সমাবেশস্থলে স্থাপিত কিউবা বিপ্লবের অন্যতম কারিগর আর্নেস্ট চে গুয়েভারা ও ক্যামিলো সিনফুয়েগোর ৫০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার বিশাল ছবির পাশে দাঁড়িয়ে পোপ লাখ লাখ মানুষের সামনে সমাজকে আরও উদার করার জন্য কিউবার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষে বিশ্বের ১২০ কোটি ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ কিউবান বিপ্লবের নায়ক সাবেক প্রেসিডেন্ট জলপাই রঙের পোশাকধারী ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বৈঠক করেন। হাভানায় অবস্থিত ভ্যাটিকানের দূতাবাসে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পোপ রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেন, যদিও সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত খবরে আমরা জানতে পারি, পোপের রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হাভানার সরকার। এর আগেও অবশ্য একবার পোপ ‘কিউবায় সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে’ বলে মন্তব্য করে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন।
বিশ্ববাসীর প্রশ্ন, আর কত দিন বলবৎ থাকবে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা? কিউবার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই লাতিন আমেরিকার এ দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ, রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক আগ্রাসন চালায় পার্শ্ববর্তী প্রভু রাষ্ট্রটি। আর এর শুরুটা ১৯৫৯ সালের ২৪ জুন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট এই পদক্ষেপকে ‘ম্যাসার্স অব ইকোনমিক ওয়ারফেয়ার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কেবল তা-ই নয়, ন্যাটো জোটের অভ্যন্তরের দেশগুলোও যাতে একই রাস্তা গ্রহণ করে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছিল। এরপর ১৯৬০ সালের ৬ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেস ঘোষণা করে, কিউবার সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবনকে দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সব রকম প্রচেষ্টা চালানো হবে, যাতে শেষ পর্যন্ত কাস্ত্রোর সরকারকে উচ্ছেদ করা যায়। এরপর চূড়ান্ত দফায় ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে মার্কিন সিনেট কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে, যা আজও বলবৎ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন বহুকাল আগেই শেষ হয়ে গেছে।
বিগত ২০ বছরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাগুলোতে ১৯৩ সদস্যদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। সম্প্রতি গত বছরের অক্টোবরের নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কিউবা ১৮৬টি দেশের সমর্থন পেয়েছে। শুধু ইসরায়েল ওয়াশিংটনের পক্ষাবলম্বন করে। তবে এই বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ফলে পিছিয়ে পড়ছে কিউবা, এমনটা মানতে নারাজ অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধা। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনডিপেন্ডেন্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো কিউবা নিউজের জন্য ওয়েবসাইটে পাঠানো এক মন্তব্যে বলেন, নিষেধাজ্ঞ আরোপের দিন থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি হিতে বিপরীতই হয়েছে। নোয়াম চমস্কি ২৮ আগস্ট ২০০৩ সালে বারনি ডয়্যারকে দেওয়া এক আলোচিত সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আসলে কিউবাকে নিয়ে আমেরিকা এত চিন্তিত, কারণ তারা ভয় পায় কাস্ত্রোর স্বাধীনতার ধারণাকে, যা দক্ষিণ গোলার্ধের লাঞ্ছিত ও দরিদ্র মানুষকে শেখাচ্ছে কীভাবে নিজেকে ধনতন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত থাকতে হয়।’
তবে বর্তমান সময়ে কিউবার অর্থনীতির হালহকিকতের দিকে তাকালে দেখা যায়, কিউবার জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড চিনিশিল্পসহ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভারী শিল্প এবং নিকেল উৎপাদনে দেশটি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। পাশাপাশি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে ৭৯ বছরের রাউল কাস্ত্রোর জামানায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার রূপায়ণের পদক্ষেপ গৃহীত হয় মূলত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতৃত্বের কাছে একদিকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রাখা এবং অন্যদিকে মুক্ত বিশ্ববাজার অর্থনীতির অভিঘাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে কিউবা। সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে কিউবা সরকার ব্যক্তিগত মালিকানায় ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট জনশক্তির ৪০ শতাংশ বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাঁরা বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ পাবেন, তাঁদের প্রথমবারের মতো কর দিতে হবে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম ঘোষণা করা হয়, ১০ লাখ সরকারি কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হবে। ওই সময় দেশের কর্মীদের প্রায় ৮৫ শতাংশই সরকারি চাকরি করত। কিউবার বর্তমান নেতা রাউল কাস্ত্রো ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাভানা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বারবার আহ্বান জানানো এর স্পষ্ট উদাহরণ। গত ডিসেম্বরে তিনি দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পার্লামেন্টকে উদ্যোগ নিতে বলেন।
বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এ প্রত্যাশা বাড়তে থাকে যে এই নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু এটি খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। দ্বীপ দেশটিতে এখন খাদ্য ও ওষুধ আরও অবাধে যেতে পারে। কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যাতায়াতও সহজ করা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কিউবানদের নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাউল কাস্ত্রোর এই অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগকে লাতিন আমেরিকার প্রকৃত ও খাঁটি মার্ক্সবাদীরা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন ও পূর্ব ইউরোপের ফলিত সমাজতন্ত্রের উলটপুরাণ দেখা দিয়েছে। এই সংকট সাময়িক, এই বিপর্যয় বেশি দিনের জন্য নয়, এটা একটা সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত, একটা নবায়নের ইঙ্গিত, আধুনিক সৃজনশীল মার্ক্সবাদের বাস্তবায়নের একটা সম্ভাবনাময় মহড়া। তাদের বিশ্বাস, পৃথিবীতে যত দিন হ্যাভস আর হ্যাভনটসের অস্তিত্ব থাকবে, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য, বঞ্চনা ও বঞ্চিতের সংঘর্ষ থাকবে, শ্রম ও পুঁজির সংঘাত বর্তমান থাকবে, তত দিন বিপ্লবী চিন্তা তথা মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে লাতিন আমেরিকার পৃথিবীতে বিরাজ করবে। তবে বিশ্ববাসী বর্তমান সময়ে দেখতে চায়, বাণিজ্য অবরোধমুক্ত নতুন কিউবা।
ফজলুল হালিম: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
redpen_ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.