ভারতের ঋণঃ কাঙালের খাট-পালঙ্ক by এম এ নোমান

‘আঙ্গো হিছের বাইর কাগু (পেছনের বাড়ির কাকা) খু-উ-ব বালা মানুষ। ক্যান্নে ব্যুইজলি? কাগু দিব কইছে। দিব কইছে তাই কাগু এত বালা, দিলে না জানি কাগু কত বালা অইব?’ দু’জন গ্রামবাসীর কথোপকথন এটি। আমাদের নোয়াখালী অঞ্চলের অতিপরিচিত ও বহুল প্রচলিত প্রবাদ এটি।

কেউ কাউকে আশা দিয়ে ঘুরাতে থাকলে কিংবা দিবে বলে না দিলে সঙ্গে সঙ্গেই এ বক্তব্য আওড়ান গ্রামের লোকজন। আমাদের অঞ্চলে এ ধরনের আরেকটি প্রবাদ রয়েছে। সেটি হলো, ‘বুঝা (বুবু) আঁরে দুগা দে, আঁই তোরে কেলা দিইয়্যুম, আইটগা (বিচিকলা) দিয়্যুম।’ ছোট বোন ওড়নার আঁচলে করে মুড়ি খাচ্ছে। কলা আর বিচিকলা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে মুড়ি নেয়ার জন্য বড় ভাই তাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এ প্রবাদটিও আমাদের অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ১৯৭২ সাল থেকে ভারত আমাদের দিবে বলে আসছে। এখনও কিছুই দেয়নি। দেবে বলে আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রয়োজনমত সবকিছুই নিচ্ছে ভারত। ভারত আমাদের দেবে বলছে, তাই আমাদের এত ভারতবন্দনা। প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি অনুযায়ী দিলে অবশ্যই আমরা পুরো ভারতকে মাথায় তুলে রাখতাম। এমন মনোভাব আমাদের অনেকেরই আচরণ, বক্তৃতা ও লেখনীতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমার অতিক্ষুদ্র উপলব্ধিতে মনে হচ্ছে, নোয়াখালী অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ দুটি ভারতের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি আর চুক্তির লঙ্ঘনের সঙ্গে মিলে যায়।
১৯৭৪-এর ১৬ মে দিল্লিতে বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দু’দেশের সীমানা নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে খ্যাত ওই চুক্তি অনুযায়ী ওইদিনই ভারত ২ দশমিক ৬৪ বর্গমাইলের বেরুবাড়ী ছিটমহলের মালিক হয়। বিনিময়ে তিনবিঘা আয়তনের করিডোর বাংলাদেশের কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার কথা থাকলেও আজও বাংলাদেশ তা পায়নি। এছাড়াও দু’দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১৬২টি (বর্তমানে ১৬৮টি) ছিটমহল চুক্তির ৬ মাসের মধ্যে বিনিময়ের কথা থাকলেও তা আজ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে এসব ছিটমহলে ২ লাখ লোক মানবেতর দিনযাপন করছে। সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন করে বেরুবাড়ী এলাকাটি বাদ দেয়া হয়েছে এবং তিনবিঘা করিডোরের মাধ্যমে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন আবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ’৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে ’৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে গেলে বেরুবাড়ী ও তিনবিঘার কী হবে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হচ্ছে না।
চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা করিডোর দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু দক্ষিণ বঙ্গপোসাগরে তালপট্টি দ্বীপটিও জোর করে দখল করে নিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের বুকে জেগে ওঠা ওই দ্বীপে এখন ভারতের পতাকা বঙ্গপোসাগরের হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। বাংলাদেশ এর আগে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপালের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের জন্য ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের মাত্র ১৭ কিলোমিটার সড়কপথ ধরে দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ চালু হয়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, চুক্তি স্বাক্ষরের ওইদিনেই ভারত আবার তা বাতিল করে। ফলে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে মাত্র ১৫ মিনিট সড়ক যোগাযোগ উন্মুক্ত থাকার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা হয়। ওই সমঝোতা অনুযায়ী বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ৩৬ ভাগ পানি পাবে এবং ভারত পাবে ৩৯ শতাংশ। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ পানি নদীর নাব্যতার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ৩৬ ভাগ তো দূরের কথা, এক শতাংশ পানিও ভারত বাংলাদেশকে দেয়নি। তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে তিস্তা নদীর সব পানি প্রত্যাহার করে তাদের সেচ প্রকল্প গড়ে তুলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, গত শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন তিনশ’ কিউসেক পানি পেয়েছে, যা বাঁধ চুঁইয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর ’৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তার আড়ম্বরপূর্ণ ভারত সফরে সম্পাদিত গঙ্গা চুক্তিকে এখনও সফল হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ চুক্তি যে ছিল বড় ধরনের প্রহসন, বাংলাদেশের মানুষ আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। চুক্তির আগে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেত, চুক্তির দুর্বলতার সুযোগে ভারত এখন বাংলাদেশকে তা থেকেও বঞ্চিত করছে। প্রমত্তা পদ্মা এখন ধুধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। গোটা উত্তরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে মরুময়তা। ভারত গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে তাদের মরু অঞ্চলে নিয়ে সেচ প্রকল্প গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করায় পদ্মার পাশাপাশি এর শাখা নদীগুলো মানুষ এখন জুতা পায়ে পার হতে পারছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট আতাউস সামাদ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় ভারতের প্রতি আকুতি জানিয়ে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মান রাখতে হলেও দয়া করে একটু পানি দিন।’ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী দুই দেশ একসঙ্গে উদযাপন করবে এবং দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। রবিঠাকুরের মূল অনুষ্ঠান হয় বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার গড়াই নদী পার হয়ে শিলাইদহে। একসময় প্রমত্তা গড়াই এখন ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। জুতা পায়ে এখন ওই নদী পার হওয়া যায়। কাজেই রবীন্দ্রনাথের মান রাখতে হলেও গড়াই নদীতে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য আতাউস সামাদ ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
ভয়াবহ সিডরে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া দেশের দক্ষিণ উপকূলের দশটি গ্রাম ভারত তাদের নিজস্ব অর্থে সংস্কার করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আমাদের সংবাদমাধ্যমে সেটা নিয়ে প্রচুর নিউজ ও ফলোআপ নিউজ প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ওই সময় ভারতের এ প্রতিশ্রুতি নিয়ে উচ্ছ্বাসও ছিল লক্ষ করার মতো। দীর্ঘ দুই বছর পার হয়ে গেল, ভারত সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বাংলাদেশে চালের মূল্য যখন আকাশচুম্বি তখন ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছুটা সহনীয় দামে চাল দেবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই চাল বাংলাদেশে এসেছিল অনেক পরে; তাও কয়েক দফা দাম বাড়িয়ে এবং আমাদের খাদ্য সংকট কেটে যাবার পর। ওই চাল নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর বক্তব্য দেশবাসীর মনে থাকার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এবার বাংলাদেশকে একশ’ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও এ ঋণের সুদের পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের দেয়া ঋণের দ্বিগুণ। তারপরেও বাংলাদেশ ও ভারতের মিডিয়ায় এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের সীমা নেই। ভারতের এ ঋণের বিষয়ে আমার এক বন্ধুর মন্তব্য হচ্ছে, ভারত যদিও এ ঋণের টাকা বাংলাদেশকে দেয়, সেটা হবে কাঙালের খাট-পালঙ্ক কেনার মতো। রাজা তার দেশের গরিব ও নিঃস্ব প্রজাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য গ্রামে একরাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এক কাঙাল (নিঃস্ব) প্রজাকে ডেকে এনে এক লাখ টাকা দিয়ে বললেন, আমি তোমার বাড়িতে বেড়াতে যাব, এ টাকা দিয়ে তুমি আমার শোয়ার জন্য ভালো দেখে একটি পালঙ্ক কিনে রাখবে। আমি ফিরে আসার সময় আমাকে সুদে-আসলে ওই টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। মাঝখান থেকে পালঙ্কটি তোমার হয়ে যাবে। তুমি ভুলে যেতে পার। তাই ধর, এ কাগজে স্বাক্ষর করে যাও। কাঙাল কৃষকপ্রজাকে যেখানে একবেলার খাবার সংগ্রহ করতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেখানে এক লাখ টাকা সুদে-আসলে প্রায় দ্বিগুণ শোধ করতে হবে। কৃষকপ্রজা অনেক কিছুই মনে মনে ভাবেন। ঘরে খাবার নেই, পালঙ্ক দিয়ে কী করব? আবার ভাবেন, রাজার রাজ্যে বসবাস করতে হবে। রাজার আশীর্বাদ নিয়েই তো তার রাজ্যে বসবাস! কাজেই রাজার ইচ্ছাই সব। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেই বাড়ি ফিরলেন কৃষক।

No comments

Powered by Blogger.