আজ সিলেট বিভাগে হরতাল-বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ২৬

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের সিলেট জেলা সভাপতি এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে এবং শিগগিরই তাঁকে খুঁজে বের করার দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার সিলেট বিভাগে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে বিএনপি। একই ঘটনায় আগামী ২২ ও ২৩ এপ্রিল সিলেটে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল।
মঙ্গলবার রাতে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ভাঙচুর করা হয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ি। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬ জনকে। বিস্তারিত আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের খবরে :
সিলেট বিভাগে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আজ : গতকাল সকালে নগরের কোর্ট পয়েন্টে জেলা ও মহানগর বিএনপির জনসভা থেকে আজকের সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি এম এ হক। সভায় নেতারা অবিলম্বে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও দাবি জানান। একইভাবে বিভাগের অন্য তিন জেলা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে স্থানীয় বিএনপি।
সিলেটে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ২৩ : গতকাল সকাল ৯টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক, সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দুপুর আড়াইটার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে তিন পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১৫টি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মিছিলে উত্তাল নগরী : সকাল থেকে মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হয় নগরী। বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পাড়া-মহল্লা থেকে খণ্ডখণ্ড মিছিল নিয়ে জড়ো হন কোর্ট পয়েন্টে। এ ছাড়া নগরের আম্বরখানা, চৌহাট্টা, সুবিদবাজার, চৌকিদেখি, মীরাবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পৃথক সমাবেশ হয়। দীর্ঘদিন পর দ্বিধাবিভক্ত সিলেটে বিএনপির দুই গ্রুপের সব নেতা-কর্মী এক প্লাটফর্মে আসেন।
কোর্ট পয়েন্টের সভায় মহানগর বিএনপির সভাপতি এম এ হকের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি দিলদার হোসেন সেলিম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল গফফার, সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আহমদ, মহানগর সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম জালালী পংকি, সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল হাসান কয়েস লোদী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, আজ বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে ইলিয়াস আলীর খোঁজ পাওয়া না গেলে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সিলেটকে অচল করে দেওয়া হবে। এদিকে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল সিলেটে শুক্রবার মসজিদ-মন্দিরে প্রার্থনার আয়োজন করেছে। শনিবার বিকেলে কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান ধর্মঘট পালনেরও ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া রবি ও সোমবার নগরে হরতাল ডেকেছে তারা।
সড়ক অবরোধ : সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সিলেট থেকে শেরপুর পর্যন্ত এলাকা অবরোধ করে রাখেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং সিলেট তামাবিল মহাসড়কও দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিল। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও যান চলাচল বন্ধ ছিল।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশিদপুর, বিশ্বনাথ-জগন্নাথপুর সড়ক, বিশ্বনাথ-লামাকাজি সড়কসহ বিশ্বনাথ ও বালাগঞ্জ উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো অবরুদ্ধ থাকায় যানবাহনের অভাবে ভোগান্তিতে পড়ে অসংখ্য মানুষ। সকালে রশিদপুরে সড়কে গাছ ফেলে এবং গাছে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাঁরা কুড়ুয়াবাজার, দয়ামীর বাজার, তাজপুর বাজার, গোয়ালাবাজার, সাদীপুর ও শেরপুর বাজার অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আবু শামা ইকবাল হায়াত পুলিশ নিয়ে অবরোধ তুলতে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাঁকে ধাওয়া করে। এ সময় অবরোধকারীরা পুলিশের দুটি অস্ত্রও ছিনিয়ে নেয়। তবে আধা ঘণ্টা পর রাস্তার পাশে বস্তায় মোড়ানো অবস্থায় অস্ত্র দুটি পাওয়া যায়।
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গ্রেপ্তার ২৩ : দুপুর আড়াইটায় রশিদপুরের অবরোধ উঠিয়ে সড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয় র‌্যাব ও পুলিশ। এ সময় র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ২০ জন আহত হন। আহতরা হলেন- কনস্টেবল নয়ন, শাহিনূর, আলমগীর ও বিশ্বনাথ উপজেলার সাংবাদিক মামুনুর রশিদ মামুন। মামুনকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দুপুর আড়াইটার পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আবু শামা ইকবাল হায়াত জানান, সংঘর্ষের পর ২৩ বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের নাম জানাতে পারেননি তিনি।
মৌলভীবাজারে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ : সকালে জেলা বিএনপির উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ শেষে কুসুমবাগে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এ সময় সড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের হস্তক্ষেপে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেয়। এদিকে দুপুর ১২টায় মৌলভীবাজার পৌরসভায় এক সংবাদ সম্মেলন করে জেলা বিএনপির নেতারা আজ বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল করিম ময়ুন, জেলা বিএনপির নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন মাতুক, আয়াছ আহমদ, এম এ রশিদ, মিজানুর রহমান মিজান প্রমুখ।
শ্রীমঙ্গলে অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, পৌর বিএনপির সভাপতি আটক : মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় দুপুর ২টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাঠিপেটা করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা শহরের স্টেশন রোড ও মৌলভীবাজার রোডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা চ্যানেল আইয়ের একটি গাড়িসহ আটটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় পুলিশ পৌর বিএনপির একাংশের সভাপতি আলম পাটোয়ারীকে আটক করে।
এদিকে বিএনপির বিক্ষোভ ও গাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদের গতকাল দুপুরে শ্রীমঙ্গল চৌমুহনী চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। সভায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
হবিগঞ্জে সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর : জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি, বাহুবলের মিরপুর, শায়েস্তাগঞ্জের নতুন ব্রিজ ও মাধবপুরে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশের কারণে ঢাকা ও সিলেটের সঙ্গে হবিগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় নেতা-কর্মীরা নবীগঞ্জের আউশাকান্দিতে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
দুপুরে হবিগঞ্জ পৌরসভা মাঠ থেকে জেলা বিএনপির উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হলে কোর্ট মসজিদ প্রাঙ্গণে পুলিশ মিছিলটির গতিরোধ করে। এ সময় মিছিল গতি পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হয়। সেখানে জেলায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করেন জেলা বিএনপির নেতারা। পুলিশ বিকেলে জেলা যুবদলের একটি মিছিলের গতিরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে যুবদলের কর্মীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। এ ছাড়া সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জেলা ছাত্রদল ও কৃষকদল এ ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শহরে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সুনামগঞ্জে অবরোধ, বিক্ষোভ : সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ধারণবাজার, গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট, জাউয়া বাজার, পাগলাবাজার, লামাকাজী পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে রাখে। এতে দুর্ভোগে পড়ে ওই সব পথে চলাচলকারী যাত্রীরা। জেলায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করেছেন জেলা বিএনপির নেতারা।
জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক হুইপ ফজলুল হক আছপিয়ার নেতৃত্বাধীন গ্রুপ দুপুর ১২টায় পুরান বাসস্টেশন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন গ্রুপের নেতা ও যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম হেলালের নেতৃত্বে বিএনপির অন্য গ্রুপ শহরের পুরাতন কোর্ট পয়েন্টে জরুরি বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করে। বিকেলে ছাতকে উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে।
শেরপুরে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, আহত ১০, গ্রেপ্তার ২ : বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দেওয়ায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাবেক এমপি, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপির দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে শহরের নিউ মার্কেট মোড়ে জেলা বিএনপির অফিস থেকে এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। খরমপুর এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে মারলে সংঘর্ষ বেধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ তিনটি রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেল এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের শেরপুর জেলা প্রতিনিধি মাসুদ হাসান বাদলসহ ১০ জন নেতা-কর্মী আহত হন।

No comments

Powered by Blogger.