তারা এখনো বাকশালী ধ্যানধারণায় মগ্ন by এম কে আনোয়ার

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি। একই সঙ্গে ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকায় সাংসদদের আসন শূন্য হওয়ার যে বিধান আছে, তা পরিবর্তন করে ৯০ দিন করারও চিন্তাভাবনা চলছে।


এ সম্পর্কে বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার গতকাল সাক্ষাৎকার দেন।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো  তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের তোড়জোড় চলছে। বিএনপি কী ভাবছে?
এম কে আনোয়ার  দলের অবস্থান আমি বলতে পারব না। আমার ব্যক্তিগত মত দিতে পারি। ২০০৯ সালের হয়তো মাঝামাঝি আইনমন্ত্রী প্রথম সংশোধনের কথা বলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা আইন কমিশনের কাছে চিঠি দেব। তাদের মতামত পাওয়ার পর আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’ এর পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করব না। বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করব।’ এর কিছুদিন পর সাংসদ শেখ সেলিম বললেন, ‘আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।’ সেই থেকেই শুরু হলো তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। তারপর কী করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে, তা আপনারা খুব ভালো জানেন।
প্রথম আলো  পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি পেয়েছেন কি? রায়ের সঙ্গে কি আপনি মিলিয়ে দেখেছেন?
এম কে আনোয়ার  এ বিষয়ে আমি একটি কপি সংগ্রহ করি। সেখানে বাংলা অংশ নেই। প্রথম কথা হলো, মাননীয় বিচারকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব, পঞ্চম সংশোধনী রায় বাতিল করে যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেটা স্ববিরোধী। সংবিধানবিরোধী কোনো আইন বা সংশোধনী করা হলে তা বাতিল করার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের আছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনীর মাত্র আটটি অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়। অথচ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তত ৪১টি অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হয়েছিল। প্রস্তাবনাসহ ওই আটটি বাদে আর সবগুলো প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে মার্জনা করা হলো।
প্রথম আলো  আপনি কি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায় এবং পুনর্মুদ্রিত সংবিধান দুটোর আলোকেই এ কথা বলছেন?
এম কে আনোয়ার  হ্যাঁ। আমি দুটো রায় পাঠ করেই বলেছি। আমি যদি আপনার তথ্য ধার করি, তাহলে বলব, প্রায় ৭০টি সংশোধনী এসেছে। অথচ পঞ্চম সংশোধনীতে করা বিচারকদের বয়স ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো বিধান টিকে গেছে।
প্রথম আলো  বিএনপির অনেকে মনে করেন, অন্তত বিচারকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাখার বিধান বিলোপ করা উচিত। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
এম কে আনোয়ার  বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়নি, তবে হওয়া উচিত। প্রধান বিচারপতির বিধানটি নিয়ে যথেষ্ট ঝামেলা আছে। কিন্তু কাকে করবেন, সে প্রশ্নটা বড়।
প্রথম আলো  সেটা আলোচনাসাপেক্ষ। তবে বিচার বিভাগের জন্য এই বিধান ভালো হয়নি।
এম কে আনোয়ার  দেশের জন্যও ভালো হয়নি। কারণ, আবার একই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সময় যেমনটা হয়েছিল। এখন আবার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়ে একই বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
প্রথম আলো  বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, তাঁর অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। সেটা কি তাঁর ব্যক্তিগত মত ছিল, না দলীয় মত?
এম কে আনোয়ার  মহাসচিব যখন বলেছেন, তখন নিশ্চয়ই তা দলের মত।
প্রথম আলো  ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে পরামর্শের বিধান তুলে নিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার রায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
এম কে আনোয়ার  তারা ওটা তুলে দিয়ে বাকশালী বিধান কায়েম করেছে। এতে মাসদার হোসেন মামলার রায় চলে গেছে, বিচার বিভাগ চলে গেছে।
প্রথম আলো  পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে সরকার যদি ভুলত্রুটি করেও থাকে, তাহলে এখন তো শোধরানোর সময় রয়েছে। আপনাদের তাতে সাড়া দিতে বাধা কোথায়?
এম কে আনোয়ার  দলীয়ভাবে যখন আমরা এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রয়েছি, তখন এ বিষয়ে কিছু বলার নেই।
প্রথম আলো  ব্যক্তিগত মত?
এম কে আনোয়ার  তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ নির্দিষ্ট করার প্রশ্নে যে প্রস্তাব তারা করছে, সেটা ইতিবাচক। তবে সংসদে অনুপস্থিতির ৯০ কার্যদিবসের পরিবর্তনের চেয়ে সংসদকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বাহাত্তর সালের সংবিধানে ফেরার কথা প্রতারণামূলক। সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে জাতির সঙ্গে আরেকটি প্রতারণা করা হয়েছে। কিন্তু তারা বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কারণ সংবিধান কোনো দলের নয়, দেশ ও জাতির। তাদের উচিত জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
প্রথম আলো  ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রশ্নে সরকার ও আপনাদের অবস্থান কাছাকাছি। উপরন্তু বিএনপি সংসদে। তারা কেন একটি বিল আনতে অপারগ থাকবে?
এম কে আনোয়ার  মুশকিল হচ্ছে, সংবিধানের কপিই তো আমরা পাইনি। আপনি ভাগ্যবান যে আগে পেয়ে লিখেছেন। আমি যেটা সংগ্রহ করেছি, সেটার আবার মধ্যখানের কয়েকটি পাতা নেই।
প্রথম আলো  তাহলে আপনি এটুকু স্বীকার করবেন যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে সরকারি দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার একটা জায়গা আছে।
এম কে আনোয়ার  সরকার যদি বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করতে চায়। কিন্তু অন্যদিকে দেখছি যে তারা বলছে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক এবং তারা সেটা সংবিধানে এমনভাবে আনবে, যাতে আর কেউ বদলাতে না পারে।
প্রথম আলো  কিন্তু এ ধরনের অভিপ্রায় কি সেই অর্থে কার্যকর?
এম কে আনোয়ার  তারা তো সেটাই বলে বেড়াচ্ছে। জজ সাহেবরা আপাতত তাদের সঙ্গে আছেন।
প্রথম আলো  আপনি কিন্তু নিজেই আপাতত শব্দটি ব্যবহার করলেন।
এম কে আনোয়ার  আপনাকে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, তারা এখনো বাকশালে ধ্যানমগ্ন। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ এখনো বাকশালের আদর্শ ধারণ করে। আমরা বাকশালের ভাবধারার চিন্তা-চেতনায় এগিয়ে যেতে চাই।
প্রথম আলো  সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আপনারা সংবিধানের কপি পাননি, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কপি পেয়েছেন। সেটা নিয়েই কমিটিতে যোগ দিতে পারেন।
এম কে আনোয়ার  এটা একটা অত্যন্ত অশোভন জবাব। আওয়ামী লীগের পক্ষেই এ ধরনের যুক্তি দেওয়া সম্ভব। বিএনপির একটি অবস্থান নির্ধারণের জন্য পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি আমরা স্বাভাবিকভাবে আশা করেছি। এরপর যখন নানা চেষ্টা করেও পেলাম না, তখন আমাদের চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। তিনি তাঁর পিএসকে দিয়ে সংবিধানের একটি কপি চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আমরা তার জবাব এখন পর্যন্ত পাইনি।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
এম কে আনোয়ার  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.