স্মরণ-বাবাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি by সুমনা হাসান

হ্যাঁ, বাবা, তোমার খেরোখাতার (দৈনিক রোজনামচা) পাতায় লিখে যাওয়া ৩০ বছর আগের অনুভূত ভাবনাগুলো যে এভাবেই সত্যি সত্যি অজান্তেই ঘটে গেছে, আজ এত বছর পর ভাবতে অবাক লাগছে। কী অদ্ভুত, তাই না? তাই খেরোখাতায় তোমার লিখে যাওয়া এই অংশটুকু দিয়েই তোমাকে স্মরণ করতে ইচ্ছা করল তোমার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকে।


২ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে দেশ হারিয়েছে শিল্পী কামরুল হাসানকে, আমি হারিয়েছি বাবাকে। লিখতে না পারার অপরাধবোধ নিয়েই ভারাক্রান্ত হূদয়ে তোমার রেখে যাওয়া ৪২টি খেরোখাতার ২১ নম্বরটি হাতে তুলে নিলাম। প্রতিটি পাতাই যেন তোমার এক একটি শৈল্পিক সৃষ্টি। প্রতিটি পাতায় বিচিত্র রঙের খেলা, আঁকিবুকি, যেন প্রতিটি পাতা তোমার বন্ধুর মতো তোমার খেলার সঙ্গী। যেন গল্প করে চলেছ তোমার মনের ইচ্ছা, অনুভূতি, আবেগ, তোমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে। এভাবেই পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই একটি পাতায় এসে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। সেই দিনটি ৪ এপ্রিল। অন্যান্য দিনের লেখার মতো এ পাতাটি নয়। এখানে নেই রঙের খেলা, সচরাচর যেমন তুমি প্রতিদিনের লেখার শেষটিতে সুন্দর একটি সমাপ্তি টানো, এখানে সেটি অনুপস্থিত। হঠাৎই যেন লিখতে লিখতে তুমি থেমে গেছ—তোমার স্বভাবসুলভ সমাপ্তি রেখার টান এখানে নেই। মনে হয় যেন অসমাপ্ত, কলমের কালি শেষ হয়ে এসেছিল, তাই ঝাপসা হয়ে গেছে, যেমন চোখে জল এলে দৃষ্টি হয়ে আসে ঝাপসা, তেমনটি।
কান্না পেলে যেমন গান গাওয়া যায় না, তেমনি খুব প্রিয় কারও জন্য ইচ্ছা করলেই লেখা যায় না, তুমিও তাই সেদিন পারনি আর লিখতে। আমি কিন্তু বুুঝে নিয়েছি, কেন তুমি আর লিখতে পারনি! আমি হাতে কলম তুলে নিলাম তোমার এই লেখার ওপর তোমাকে কিছু জানাতে ইচ্ছা হলো বলে।
হ্যাঁ, বাবা, ইচ্ছা করলেও তোমাকে এখন আর দেখতে পাই না। তোমার অভাব বোধ করছি, শুধু আমিই নই, অনেকেই। তার পরও প্রতিবার তোমার কাছে যাই আমার ছেলেকে নিয়ে। কী অদ্ভুত, তাই না? ঠিক তোমার লিখে যাওয়া কথাগুলোর মতো ওর নানা প্রশ্নের উত্তর আমাকেই দিতে হয়েছে। ও জিজ্ঞেস করত, ওর নানা কেন শুধু কার্টুন আঁকত। কারণ ওর কাছে তোমার রঙিন রঙিন গরু, পাখির ছবিগুলো কার্টুনের মতো মনে হতো। তখন ওর বয়স তিন বছর। এখন ও ১৯ বছরের তরুণ। আমার মধ্য দিয়ে ও তোমাকে বোঝার চেষ্টা করে। আমি আমার মতো করেই ওকে গড়ে তুলছি। মা আর ছেলেতে মিলে প্রতিবারই তোমাকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিই। তোমার সঙ্গে আমরা সময় কাটাই। তোমার রেখে যাওয়া খেরোখাতার অধিকার পেতে আমাকে দীর্ঘ ২৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছি আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অধিকার থেকে।
তার পরও আমি তোমার সন্তান, যাকে তুমি এই দিনে পরম স্নেহে এবং ভালোবাসায় তোমার কোলে আগলে ধরে রেখেছিলে, কোনো ঝড়ঝাপ্টা যাতে তাকে স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু তোমার অজান্তেই তোমার পরিবার ও সমাজের প্রতি প্রচণ্ড রকম দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ কখন যেন তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে, যা তুমিও বুঝতে পারনি। এতে তোমার বা আমার কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব-নিকাশ না-ই বা করলাম, কিন্তু লাভবান হয়েছে অনেকেই, যাদের তুমি তোমার সরল বিশ্বাসে একচ্ছত্র অধিকার দিয়ে গেছ বলে তাদের দাবি।
যখন বুঝতে পারলে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই যেন তুমি হঠাৎই ভীষণ তাড়াহুড়ো করে সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে। কিন্তু মৃত্যু তোমাকে সেই সময়টুকু আর দিল না। তার আগেই তুমি চলে গেলে আর আমার জন্য রেখে গেলে কেবল তোমার মতো একজন কৃতী পুরুষের সন্তান হওয়ার গর্ব। তার পরও আমি তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করে চলেছি। এতেই আমি ভীষণ গর্বিত, বাবা...!

No comments

Powered by Blogger.