ব্লাড ষাটেই ভাবতেন পাকিস্তান ভেঙে যাবে

একাত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ষাটের দশকেও বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ছিলেন। একাত্তরে ওয়াশিংটন শুনতে চেয়েছিল ইয়াহিয়ার গুণকীর্তন। আর ষাটের দশকে একইভাবে তারা শুনতে চেয়েছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের গুণগান।


ষাটের দশকে গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল ব্লাডের। বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। কিন্তু ওয়াশিংটনের তা পছন্দনীয় ছিল না। আইয়ুব অজনপ্রিয়, গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান জনপ্রিয়—এ কথা বলে তিনি তখনো বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আর সে সময় থেকেই তিনি ভাবতেন, পাকিস্তান টিকবে না। ভেঙে যাবে। ওই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছিল তাঁর চোখে ‘শোষিত উপনিবেশ’। ১৯৮৯ সালে মার্কিন কথ্য ইতিহাসবিদ হেনরি প্রেখটকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মিজানুর রহমান খান

গতকালের পর
ব্লাড একাত্তরে ঢাকায় তাঁর ভূমিকার জন্য মার্কিন সিনেটে জুডিশিয়াল সাব-কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তখন ওই কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল উদ্বাস্তু পরিস্থিতির তদারক করা। ওই সাব-কমিটির সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের আরেক মহান বন্ধু সিনেটর টেড কেনেডি। কমিটি বিষয়ে ব্লাড বলেছেন, ‘তাঁরা যখন আমাকে স্পর্শকাতর প্রশ্ন করা শুরু করলেন, তখন আমি বললাম, আমাদের উচিত হবে একটি নির্বাহী অধিবেশন ডাকা। এরপর তাঁরা থেমে যান। কমিটিতে আমি যা বলেছিলাম, তাতে কারও আপত্তি করার মতো কোনো কিছুই ছিল না। ক্রিসও বলেছিলেন, আমরা পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলাম। ব্লাড যা করেছেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। অবশ্য তখন সিড সোবার ওয়াশিংটনে ছিলেন না। আমি তখনো পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অনুগত কর্মকর্তা।’
উল্লেখ্য, ঢাকায় তাঁর বাঙালিপন্থী ভূমিকা নিয়ে ড. হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত উষ্মার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সার্ভিসের প্রায় সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সাক্ষাৎকারেও হেনরি প্রেখট বারবার তা উল্লেখ করেন। যেমন, হেনরি প্রেখট তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে ওয়াশিংটনে ফিরে আপনি একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। আর তিনি হলেন হেনরি কিসিঞ্জার।’ জবাবে ব্লাড বলেছেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছেন। তবে রজার্সের কথা বলতেই হয়। তিনি আমাকে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য হার্টার পুরস্কার প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। আমি মনে করি, তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বিব্রত ছিলেন। আমি নিশ্চিত যে কিসিঞ্জার সম্ভবত তাঁকে বলেছেন, ‘আরে, দেখো তোমার ডিপার্টমেন্টের লোকজন কেমন। তারা এমনকি সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করতে জানে না।’
মুজিবকে দেখতে গিয়ে: ব্লাডের দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেখা যায় তিনি যখন ঢাকায় কনসাল জেনারেল ছিলেন, তখন তাঁর ডেপুটি ছিলেন বব কার্ল। তিনি কিছুদিন তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরপর যিনি এলেন, তিনিও একই সমস্যায় পড়লেন। তিনি যুদ্ধের পরে মুজিবের বীরোচিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়েও ঢাকায় ছিলেন। ওয়াশিংটন তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছিল যে তিনি যেন মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বিমানবন্দরে না যান। কিন্তু তিনি তা অগ্রাহ্য করেন। বিমানবন্দরে যান। এবং তাঁর ভাগ্যেও ঝটিকা বদলি জোটে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ব্লাড নিশ্চিত করেন যে বাংলাদেশের ঘটনাবলি তিনি ওয়াশিংটনে ফিরেও ঘনিষ্ঠভাবে নজর রেখেছিলেন। তবে বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো পরামর্শ বা কোনো আলাপ-আলোচনায় পররাষ্ট্র দপ্তর তাঁর সঙ্গে আর কোনো কথা বলেনি। উল্লেখ্য, হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকায় তাঁর ভিন্নমতের জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন। কূটনীতিকের পেশার অনেক দূরবর্তী পার্সোনাল শাখায় তাঁকে বদলি করা হয়।
ভাঙন অবশ্যম্ভাবী: ব্লাডকে যখন প্রশ্ন করা হয়, আপনার কি মনে হয় পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার সবকিছুই অবশ্যম্ভাবী ছিল? ব্লাডের সাফ জবাব, ‘আমি মনে করি শুরু থেকেই পাকিস্তানের ভাঙন ছিল অবশ্যম্ভাবী।’ হেনরি প্রেখট তাঁকে বলেছিলেন, কিসিঞ্জার বলেছেন তিনিও তেমনটাই ভাবতেন। আপনি কি কখনো অনুভব করেছিলেন যে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হতে যাচ্ছে, সেটা ওয়াশিংটনের ভাবনায় ছিল। ব্লাড বলেন, ‘না, আমি তা মনে করি না যে সেটা ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বরং সব সময়ই এই আশাবাদ বজায় ছিল যে এই দুই অংশ একত্রে থাকবে।’ পাকিস্তানের ভাঙন প্রশ্নে দুজনের কথোপকথন এ রকম গড়ায়:
প্রেখট: কিন্তু কিসিঞ্জার বলেছেন, তিনি এটা অনুভব করেছিলেন যে এমন কিছুই ঘটতে চলেছে। আমি বলতে চাইছি, কোন পর্যায়ে আমাদের কী করার ছিল। যাতে এই দ্বিখণ্ডিতকরণ কম সহিংস, কম দুঃখজনকভাবে ঘটতে পারত। কিংবা সেটা কি এড়ানো সম্ভব ছিল? দুই পাকিস্তানের একটি শান্তিপূর্ণ বিভক্তিকরণ হতে পারত।
ব্লাড: সমঝোতার আগে আমি তো বুঝতে পারি না, কী করে কার্যকর কোনো হস্তক্ষেপ হতে পারত। সেখানে নির্বাচন হয়েছিল। জনগণ নির্বাচনের ফলাফল কোন দিকে পরিচালিত করবে, সে নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল।

পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা
প্রেখট: পাকিস্তানিরা গ্রহণ করতে পারত, এমন কোনো পরামর্শ আমরা তাদের দিইনি। আমরা তাদের কি দিতে পারতাম না?
ব্লাড: আমি তা-ই মনে করি। আমরা নিজেরাই একটা ক্র্যাকডাউন করতে পারতাম। আমি বোঝাতে চেয়েছি, ২৫ মার্চের পাকিস্তানি ক্র্যাকডাউনের বিষয়ে আমরা আমাদের অসন্তুষ্টি জানিয়ে দিতে পারতাম। এবং কোনো প্রকারের অস্পষ্টতা না রেখেই বলতে পারতাম, আপনাদের এই পদক্ষেপই হলো অবিভক্ত পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা।
প্রেখট: কিন্তু সেটা আমাদের জন্য কী বয়ে আনত? আমরা যদি সেই ক্র্যাকডাউনের জন্য কঠোর মনোভাব দেখাতাম, তাহলে কী ফলাফল বয়ে আসতে পারত?
ব্লাড: আমরা সেটা করলে পাকিস্তানকে তার পথ থেকে হয়তো সরানো যেত না, কিন্তু তাতে আমাদের অবস্থান সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে গ্রহণ করা হতো। এবং তাতে আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পেত। এমন কিছু সময় আসে, যখন সেটা করাই শ্রেষ্ঠতম মনে হয়। এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, কারণ এ জন্য আপনাকে মাশুল দিতে হয়। এ জন্য আমরা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে মাশুল দিয়েছি। আমি বোঝাতে চাইছি, একটি বিরোধের পরাজিত পক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সম্পৃক্ত হচ্ছি। সেই অবস্থানের অনুকূলে একমাত্র সংগত যুক্তি হচ্ছে, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্মুক্ত করা। এবং আমরা তখন সে বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আমাদের কাছে এর কোনো ইঙ্গিতই ছিল না।
পার্সোনাল বিভাগের দিনগুলো সম্পর্কে ব্লাড বলেছেন, ‘আমি সেখানে ক্লিওর সঙ্গে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। ক্লিও ছিলেন ফরেন সার্ভিস অ্যাসাইনমেন্ট বিভাগের প্রধান। আমি হলাম তাঁর ডেপুটি। তিনি সুদানে গেলে আমি তাঁর অবস্থানে উঠি। কিসিঞ্জার যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আসেন, তখন তিনি ছিলেন ফরেন সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। কিসিঞ্জার এসে ন্যাট ডেভিসকে মহাপরিচালক করেন। ন্যাট তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কী চান।’ জবাবে ব্লাড বলেছিলেন, ‘সবাই যেমনটা চায়, কোনো একটা দূতাবাসে বদলি।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘কিসিঞ্জার যতক্ষণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন ততক্ষণ আমার ভাগ্যে তা জুটবে না।’ ন্যাট বলেছিলেন, ‘চেষ্টা করে দেখব।’ আমার নাম পাঠানো হলো মাল্টায়।
কিসিঞ্জার টেবিল চাপড়ান: এ সময় ন্যাট ব্লাডকে ভারতে একটি সম্মেলনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ন্যাট হঠাৎ ব্লাডকে তাঁর বাড়িতে ডেকে নেন। আর তখন তাঁকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী (কিসিঞ্জার) যেই মাত্র আমার নাম শুনলেন, তখন টেবিল চাপড়ান। বললেন, ‘ওঁকে ওয়াশিংটনের বাইরে পাঠিয়ে দিন।’ ন্যাট বললেন, ‘সুতরাং আপনাকে ওয়াশিংটনের বাইরে যেতে হবে। কোথায় যেতে চান। দ্রুত বলতে হবে।’ ব্লাড আর্মি ওয়ার কলেজের কথা বলেন। পরে তাঁকে আকস্মিকভাবে সেখানেই যেতে হলো। কার্টার প্রশাসন না আসা পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকলেন। এরপর ব্লাড ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর নয়াদিল্লির মার্কিন মিশনে বদলি হয়ে যান। চার বছর পর ১৯৮১ সালের ১ অক্টোবর তিনি দিল্লি ত্যাগ করেন। ভারত সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিউদিল্লি দক্ষিণ এশিয়ার রাজধানী। লোকজনের সঙ্গে অনেক সহজেই মেশা যায়। তারা খোলা মনের। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি তর্কপ্রিয়। আমি সেটা উপভোগ করি।’
প্রকৃত মিত্র নয়: এরপর প্রেখট তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিসিঞ্জার তাঁর বইয়ে ভারতের প্রতি পররাষ্ট্র দপ্তরের (আমলাতন্ত্রের) ঝোঁকের বিষয়ে লিখেছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তর তখন কি ভাবত যে ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। পাকিস্তানঘেঁষা নীতি বাদ দিয়ে ওয়াশিংটনের উচিত দিল্লির প্রতি অধিকতর মনোযোগী হওয়া। ব্লাড বলেছেন, ‘আমি সেটাই মনে করি। আমাদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা পাকিস্তানে কাজ করেছি, আমরা পাকিস্তানিদের পছন্দ করেছি। পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগী হয়েছি। কিন্তু এই ধারণার প্রতি সব সময়ই সন্দেহপ্রবণ থেকে গেছি যে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা মিত্র নয়। আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমাদের স্বার্থে তারা ততটা ঘনিষ্ঠ নয়। পাকিস্তানিরা মাঝেমধ্যে সহযোগিতা দিতে পারে। কিন্তু ব্রিটেন, জার্মানি এমনকি ফ্রান্সও যে অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, তারা সেই অর্থে মিত্র নয়। তারা তাদের নিজস্ব স্বার্থে, বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা করে থাকে। ওই এলাকায় আমরা যাঁরাই কাজ করেছি, তাঁরাই এটা স্বীকার করেছি যে ভারতই ওই অঞ্চলের বড় শক্তি এবং কালক্রমে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আমি সম্ভবত পাকিস্তানিদের চেয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে কাজ করা পছন্দ করেছি।’
হেনরি প্রেখট এরপর তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, ভারতে আপনি ডেপুটি চিফ অব মিশন হয়ে এলেন। আপনাকে তো তারা জানত। ঢাকায় আপনার ভূমিকা, ভারতীয়দের কাছে নিশ্চয়ই এটা একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল। সেটা কি সহায়ক হয়েছিল? ব্লাড বলেছেন, ‘হ্যাঁ, সেটা কাজে দিয়েছিল। যদিও প্রকাশ্যে কখনো কিছু বলা হয়নি, তবে সাংবাদিকেরা এটা জানতেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাকে এমনভাবে দেখত যে আমি এমন একজন, যিনি ভারতের প্রতি বৈরী নন।’
সপ্তম নৌবহর: হেনরি প্রেখট প্রশ্ন রেখেছিলেন, ভারত কেন পারমাণবিক কর্মসূচি নিল। পূর্ব পাকিস্তানসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি এ ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেছিল? কিংবা পাকিস্তানের প্রতি আমাদের ঝুঁকি থাকা নীতি। উত্তরে ব্লাড বলেছেন, ‘আমার ধারণা, এর কতগুলো কারণ ছিল। চীনারা ১৯৬৪ সালে পারমাণবিক হলো। তখন ভারত ভাবল, চীনের সমকক্ষ হবে। পাকিস্তানের মর্যাদায় নয়। আমরা ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে যখন সপ্তম নৌবহর পাঠালাম, তখন ভারতীয়দের মধ্যে জল্পনাকল্পনা ছিল, যদি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র “শো অব ফোর্স” হিসেবে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে দ্বিধান্বিত থাকত। তবে আমি মনে করি, চীনারা করেছিল বলে ভারত করেছে। উপরন্তু এটা একটা মর্যাদারও বিষয়।’
এক মার্কিন তরুণের কাণ্ড: ১৯৬২ সালের গ্রীষ্মে ব্লাড প্রথম ঢাকায় আসেন। ছিলেন ভূমধ্যসাগরে। এলেন বঙ্গোপসাগরে। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব সমর্থনযোগ্য নয়। এই সাক্ষাৎকার থেকে দেখা যায়, ওয়াশিংটনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর মতবিরোধ ১৯৬২ সালেও ঘটেছিল, একাত্তরেই প্রথম নয়। সে কারণেই হেনরি প্রেখট তাঁকে প্রশ্ন রাখেন, বাঙালিদের মনোভাব সম্পর্কে আপনি যে রিপোর্ট তখন পাঠাতেন, তাতে ওয়াশিংটন খুশি হতে পারেনি। উত্তরে ব্লাড বলেছেন, ‘তারা কখনো প্রকাশ্যে আপত্তি তোলেনি। কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা যেমন রিপোর্ট করতাম আইয়ুব খান এখানে অজনপ্রিয়। গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান জনপ্রিয়। আর সেটাই তাঁর জন্য বিপদ আসতে পারে। আইয়ুব তাঁকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে পারেন। সে জন্য তাঁকে অপসারণ করতে পারেন।’
আরেকটি গল্প বলি। ১৯৬১ সালের গ্রীষ্মকাল। এক মার্কিন তরুণ ঢাকায় এলেন। একটি ফার্ম ব্যুরোর এক্সচেঞ্জের আওতায়। তিনি একটি বাঙালি ফার্মে কাজ করেছিলেন। ওয়াশিংটনে ফিরে তিনি উল্টো গীত গাইলেন। বললেন, ‘আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তানে ভীষণ জনপ্রিয়। বাঙালিরা লে. জেনারেল আজম খানকে পছন্দ করে না।’ ব্লাড বলেন, ‘এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট ডেস্ক থেকে একটি বার্তা পেলাম। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমরা তো এসব তথ্য পেলাম। আপনার মন্তব্য কী? আমি এতটাই বিরক্ত ছিলাম যে, আমি নিরুত্তর থাকলাম। তবে আমাকে সেটা সচকিত করল। তারা আসলে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একজনের কাছ থেকে তারা এমন কিছু শুনল, যা তারা শুনতে চেয়েছিল। আর সেটাই তারা আঁকড়ে ধরল।’
সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে: প্রেখট তাঁকে প্রশ্ন রেখেছেন, ষাটের দশকের অসুখী বাঙালিদের সঙ্গে আপনি মিশতেন। বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলতেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেটা কী চোখে দেখেছিল? এ নিয়ে তারা কি কোনো নালিশ দিয়েছিল? জবাবে ব্লাড বলেছেন, ‘আমি স্মরণ করতে পারি, তারা এটা মাঝেমধ্যে করেছিল। মি. সোহরাওয়ার্দীর কারণে আমি মাঝেমধ্যে ঝামেলায় পড়তাম। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। আমার সময়টায় তিনি অবসর জীবন যাপন করতেন। তিনি প্রায়ই আমাকে তাঁর বাড়িতে ডাকতেন। বলতেন, এসো ছবি দেখি। কিংবা এটা সেটা করি। আমি বিষয়টি আড়ালে রাখার চেষ্টা করতাম। কারণ, এটা প্রকাশ পেলে সেটা হবে বিব্রতকর। পাকিস্তান সরকার সেটা পছন্দ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও তা হতে পারে বিব্রতকর। তা ছাড়া সেই মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার মতো উল্লেখযোগ্য নেতা তিনি ছিলেন না।’ তবে মজার বিষয় হলো, ওই সময়েও পশ্চিম পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে ঢাকা কনস্যুলেটের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্লাড বলেছেন, খুবই দুঃখজনক। অবশ্য প্রতিটি দূতাবাসের সঙ্গেই কনস্যুলেটের শিথিল সম্পর্ক থাকে। ঢাকার সঙ্গে ছিল খুবই খারাপ।
স্বাধীনতার কথা ভাবেনি: ওই সময় ঢাকায় সিআইএর তৎপরতা সম্পর্কে ব্লাড বলেছেন, ‘তারা সংখ্যায় কম ছিল। দুজন কর্মকর্তা ও একজন সচিব। আমরা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতাম। কোনো ঝুটঝামেলা হয়নি।’ ওই সময়ে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা প্রশ্নে কী ধরনের কথাবার্তা পূর্ব পাকিস্তানে তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, সে-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ব্লাড বলেছেন, ‘সেই সময় বাঙালিরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতেন না। তাঁরা শুধুই তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক দুঃখ-কষ্টের কথা বলতেন এবং তাঁদের বক্তব্য যথার্থ ছিল। জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ অনেক বেশি সম্পদশালী ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ করত।’ হেনরি প্রেখট প্রশ্ন রাখেন, তাহলে সেটা একটা ‘শোষিত উপনিবেশ’ ছিল? ব্লাড বলেছেন, ‘হ্যাঁ, বাঙালিরা ঠিক তেমনটাই ভাবতেন। আমি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে আশা দেখেছিলাম।’ শেষ

No comments

Powered by Blogger.