চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের বিরোধ এবং প্রসঙ্গ কথা by ড. মিল্টন বিশ্বাস

কালের কণ্ঠে গত ১৮ মার্চ প্রকাশিত 'বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেও এক হতে পারেনি চট্টগ্রাম আ. লীগ' এবং গত ৭ তারিখে প্রকাশিত 'হাসিনার নির্দেশের পরও মেটেনি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব' শীর্ষক দুটি সংবাদ রাজনীতি-সচেতন মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।


কারণ ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতবিনিময়কালে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশের পরও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের অভ্যন্তরীণ বিরোধ অমীমাংসিত থাকার দৃষ্টান্ত হিসেবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এবং ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দুই পক্ষের পৃথকভাবে অনুষ্ঠান করার কথা উল্লেখ করা হয় সংবাদে। অনেক দিন ধরে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করার পুরনো আচরণও লক্ষ করা যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দলীয় তিন প্রবীণ নেতাকে বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের বিভেদ বিচলিত করছে সাধারণ মানুষকে। উল্লেখ্য, মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষ থেকে দাবি, সভাপতি ও সম্পাদক কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত। তাঁদের নেতৃত্বাধীন কমিটিই বৈধ। সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, সাবেক সংসদ সদস্য ইসহাক মিয়া এবং আ জ ম নাসির উদ্দিন এক পক্ষে। অন্যদিকে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম বিএসসি, মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী, সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুছ ছালাম, মহানগরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন রয়েছেন অন্য পক্ষে। ২০১০ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে এখানকার আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল স্পষ্ট হতে থাকে। সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয় নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফল বলা হলেও এর পেছনে অন্য আরো কারণ ছিল বলে আমরা মনে করি। তবে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির একজন যোগ্য নেতা হিসেবে নিজেকে নগরবাসীর কাছে পরিচিত করাতে সক্ষম হন।
গত বছরের ১৮ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর দেশের গণমাধ্যমে নির্বাচন সম্পর্কে বিচিত্র ধরনের বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। এর অধিকাংশই পক্ষপাতদুষ্ট, একপাক্ষিক এবং এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথিত অভিযোগের সমষ্টি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবদান, মেয়র হওয়ার আগে গণমানুষের প্রতি দরদ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আলোকপাত না করে একতরফাভাবে তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। মহিউদ্দিন চৌধুরীর যোগ্য নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যে অবস্থায় পেঁৗছেছে, তার মূল্যায়ন করে নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ উদ্ঘাটন করা দরকার ছিল। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করায় সাবেক এই মেয়র চট্টগ্রামকে একটি বাসযোগ্য মনোরম শহরে পরিণত করার প্রয়াস পান। এর সুফল বর্তমান প্রজন্ম ভোগ করছে। কেবল শহরের অবকাঠামোগত দিকই নয়, তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন এই এলাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিকে, মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে।
অভিযোগ আছে, ২০১০ সালের ২৮ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠকে নেতা এবং মন্ত্রীদের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও অনেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেছিলেন এবং নির্বাচনী প্রচারণায় সময় দেননি। উপরন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেন। চট্টগ্রামের ৫০ লাখ মানুষের সঙ্গে তিনি খারাপ আচরণ করেছিলেন, এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। প্রত্যেক মানুষের আচার-আচরণ একেবারে কাছের ব্যক্তির সঙ্গেও ভিন্নতর হতে পারে। গত বছর দু-একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে_মহিউদ্দিন চৌধুরীর দম্ভ ও অহমিকা তাঁর পতনের কারণ। তাঁর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত। সিটি করপোরেশন প্রশাসন পরিচালনায় তিনি হয়তো দম্ভ ও অহমিকা দেখিয়েছিলেন করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে, কিন্তু জনসাধারণকে তিনি কখনো ক্ষমতার দম্ভ দেখাননি। লালদীঘির ময়দান ছাড়াও চট্টগ্রামের জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ হয়েছে বারবার। এ জন্য নির্বাচনে পরাজয়ের সঙ্গে অহমিকা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন। এ অভিযোগও মনে হয় সত্য নয়।
মেয়র নির্বাচনের সময় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ মোবাইল ফোনে তাঁদের কর্মীদের বিএনপির পক্ষে প্রচার করতে বলেছেন_এ ধরনের তথ্য অনেকের মোবাইল ফোনসেটে রেকর্ড করা আছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সেই সময় দু-একজন ছাড়া চট্টগ্রামের সংসদ সদস্যদের কাউকে সক্রিয় কোনো প্রচারে দেখা যায়নি। বরং ঢাকা, কুমিল্লা ও বরিশাল থেকে আগত নেতারা অনেক বেশি প্রচার-প্রচারণার কাজ করেছিলেন। অন্যদিকে ফল প্রকাশের পর সুশীল সমাজের কয়েকজন চেয়েছিলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজয় স্বীকার করে মঞ্জুকে অভিনন্দন জানান। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যে চার লাখের মতো মানুষ ভোট দিয়েছে, তারা তো তাঁকে জয়ী করার জন্য ভোট দিয়েছে। তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তারা চায়নি, পরাজয় স্বীকারের ঘোষণা তাঁর কাছ থেকে আসুক। মহিউদ্দিন চৌধুরী এখনো সজীব, প্রাণবন্ত। তৃণমূল পর্যায় থেকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি সারা দেশের জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম শহরের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, নিজেদের মধ্যে বিরোধের ফলে আগামী দিনগুলোতে দলের ভেতর ঐক্য বিনষ্ট হবে; তরুণ প্রজন্ম দিশেহারা হবে। সিটি মেয়র পদে পরাজয়ের পর মহিউদ্দিন চৌধুরীর নিজ হাতে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে যেমন বিবর্ণ করার চেষ্টা হচ্ছে, তেমনি আওয়ামী লীগের পুরনো ঐতিহ্য বিনষ্ট হবে নিজেদের বিরোধ ও কোন্দলের কারণে। তবে নেতৃত্বের বিরোধ মীমাংসা হওয়ার প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব হিসেবে আ জ ম নাসির উদ্দিন ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর মতে, বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে পথ খোঁজা দরকার। নগর আওয়ামী লীগে কার কতটুকু অবদান, সে ব্যাপারে সবাইকে অবগত করলে উভয় পক্ষ জনগণের সামনে নিজেদের যাচাই করার সুযোগ পাবে। এতে বিএনপি-জামায়াত অথবা সুযোগসন্ধানীরা কুপোকাত হবে; দলের শৃঙ্খলাও বজায় থাকবে। তরুণ প্রজন্ম বৃহৎ দলের মূলনীতি-আদর্শ বুঝতে সক্ষম হবে। বড় দলের ভেতর মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু তা যেন আত্মঘাতী না হয়ে ওঠে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
dr.miltonbis@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.