আরব জাগরণ-লড়াই একদমই শেষ হয়ে যায়নি by তারিক আলী

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের খোলস ব্যবহার করে লিবিয়ায় মার্কিন-ন্যাটো সামরিক হস্তক্ষেপ হলো এক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনের সুসজ্জিত প্রতিক্রিয়ার অংশ। এর মাধ্যমে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে আরব বিদ্রোহের ইতি টানা, বিদ্রোহের গতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা খর্ব করা এবং আগের অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।


ত্রিপোলিতে বোমা হামলা কিংবা বেনগাজির বাইরে অবস্থানরত গাদ্দাফি বাহিনীকে ঘায়েল করতে বিমান হামলার কারণ বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা—এমন ভাবা হাস্যকর। এই যুক্তি অবতারণার উদ্দেশ্য ইউরো-আমেরিকাবাসী এবং আরবের কিছু অংশের নাগরিকদের সমর্থন আদায়। ওবামা/হিলারি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের শাসকেরা বলছেন, ‘দেখ, আমরা ভালো কাজ করছি। আমরা জনগণের পক্ষে।’ এই পুরোদস্তুর নৈরাশ্য শ্বাসরুদ্ধকর। আশা করা হচ্ছে, আমরা যেন বিশ্বাস করি ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যে নেতাদের হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে, তাঁরা লিবিয়ার জনগণকে রক্ষা করছেন। ব্রিটিশ ও ফরাসি অধোপতিত গণমাধ্যম সবকিছু হজম করে ফেলতে পারে। কিন্তু চোস্ত উদারবাদীরা এখনো জঞ্জালেই আশ্রয় নিচ্ছেন, এ তো বড় খারাপ লাগার ব্যাপার। কতগুলো ছবি খুব সহজে সুশীল সমাজকে নাড়িয়ে দেয়। নিজ জনগণকে বোমা মারতে গাদ্দাফির বিমানবাহিনী পাঠানোর বর্বরতাকে অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়ে আরেকটি আরব রাজধানীতে বোমা ফেলতে ব্যবহার করেছে ওয়াশিংটন। অন্যদিকে, ওবামার অন্যান্য আরব মিত্র নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের বিকাশে খুব ব্যস্ত!
সৌদি সিপাহি বাহরাইনে ঢুকেছে। বাহরাইনের জনগণ স্বৈরশাসনের শিকার। বিপুল পরিমাণে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। এসব খবর আল-জাজিরায় তেমন আসেনি। কেন? বিস্ময় জাগে। মনে হচ্ছে, টিভি স্টেশনটি তার অর্থ জোগানদাতাদের কথামতোই চলছে আর এর ওপর লাগাম পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসবই ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থনে। ইয়েমেনের স্বৈরশাসককে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অপছন্দ করে—প্রতিদিন তার বাহিনীর হাতে খুন হচ্ছে মানুষ। কোনো অস্ত্র অবরোধ আরোপ করতেও দেখা গেল না, ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা’র (নো ফ্লাই জোন) কথা না-হয় বাদই দিলাম। যুক্তরাষ্ট্র বেছে বেছে আইন প্রয়োগের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার আরেক দৃষ্টান্ত লিবিয়া।
তারা ফরাসিদের ওপরও ভরসা করতে পারে। কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। তিউনিসিয়ায় তাঁর বন্ধু বেন আলীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, গাদ্দাফিকে হটাতে সহায়তা করতে হবে। ব্রিটিশরা সব সময় বাধ্য, আর এ ক্ষেত্রে বিগত দুই দশকজুড়ে লিবীয় সরকারকে ঠেকা দিয়ে এসে তারা এখন নিশ্চিত করতে চাইছে যে তারা ঠিক পক্ষে অবস্থান করছে, যাতে লুটের ভাগ না হারায়। কী কী পাবে তারা?
পুরো অভিযান নিয়ে মার্কিন রাজনৈতিক-সামরিক অভিজাতদের মধ্যকার বিভক্তির মানে তাদের সামনে পরিষ্কার লক্ষ্য নেই। ওবামা ও ইউরোপীয় শাসককুল লিবিয়ায় শাসক পরিবর্তনের কথা বলে। জেনারেলরা প্রতিবাদ করে। বলে, এটা তাদের লক্ষ্যের মধ্যে নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইংরেজিভাষী লিবীয় দোসরদের নিয়ে নতুন সরকার গড়ায় ব্যস্ত। শক্তিশালী বিরোধিতা মোকাবিলায় জানি না কত দিন টিকে থাকবে গাদ্দাফির বিধ্বস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়া বাহিনী। নিজ জনগণের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে গাদ্দাফি সশস্ত্র বাহিনীর ভেতর সমর্থন হারিয়ে ছিলেন। এখন তিনি বলছেন তাঁকে উৎখাতে সাম্রাজ্যবাদের বাসনা আর তেল লুটে নেওয়ার কথা। যারা তাঁকে ঘৃণা করে, তারাও এখন দেখছে যে গাদ্দাফির এ কথা সত্যি। নতুন কারজাই তৈরি হওয়ার পথে।
পশ্চিম তাদের যে আশ্রিত রাজ্য তৈরি করতে যাচ্ছে, তার সীমারেখা ঠিক হবে ওয়াশিংটনে। যেসব লিবীয় তাদের মরিয়াপনা থেকে এখন ন্যাটোর বোমারু বিমানের পক্ষাবলম্বন করছে, তারাও হয়তো ইরাকে তাদের সহযাত্রীদের মতোই কিছুদিন পর আজকের ভূমিকার জন্য আফসোস করবে।
এসবের ফলে একসময় তৃতীয় দশা—ক্রমশ বাড়তে থাকা জাতীয়তাবাদী রোষের সূত্রপাত হতে পারে—নিঃসন্দেহে সৌদি আরব ও এখানে তা ফুঁসে উঠছে। সৌদি রাজপরিবারকে ক্ষমতাসীন রাখতে সম্ভবপর সবকিছুই করবে ওয়াশিংটন। সৌদি আরব নাগালের বাইরে চলে গেলে উপসাগরীয় দেশগুলোও চলে যাবে। নাগরিক অধিকারের রক্ষকরূপে হাজির হয়ে রাজপথে গণজাগরণের ঢেউকে নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে যেতে উদেশ্যপ্রণোদিতভাবে লিবিয়ায় এই হামলা চালানো। গাদ্দাফির নির্বুদ্ধিতা সর্বক্ষেত্রে এ কাজে পশ্চিমাদের সহায়ক হয়েছে। বাহরাইনি, মিসরীয়, তিউনিসীয়, সৌদি, ইয়েমেনিদের এভাবে বুঝ দেওয়া যাবে না। ইউরোপ-আমেরিকায়ও চলতি নতুন অভিযানের সমর্থকের চেয়ে বিরোধীরাই বেশি। লড়াই একদমই শেষ হয়ে যায়নি।
ওবামা বলেন, গাদ্দাফি দয়ামায়াহীন। কিন্তু পশ্চিমাদের নিজস্ব দয়া কখনো আসমান থেকে শান্ত বৃষ্টিপাতের মতো নিচের জমিনে ঝরে পড়ে না। যেসব শক্তি সবচেয়ে শক্তিধরকে ছাড় দেয়, তাদের ওপরই বর্ষে তাদের মঙ্গলবারি।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
তারিক আলী: পাকিস্তানি-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.