দুর্ঘটনা-যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের by মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী

দেশে অবশ্যই আইন আছে, তবে আইনের প্রয়োগ নেই। যে মানার সে মানে না, যে মানানোর সে মানায় না। প্রতিদিন অগুনতি মানুষ নানা কারণে প্রাণ হারায়। রাষ্ট্র্র নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। আমাদের জীবন মানুষের জীবন নয়, আমাদের জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের


একটি ঘোড়াকে পানির কাছে টেনে নেওয়া যায়, জোর করে তার মাথাসুদ্ধ পানিতে চুবিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু ঘোড়াটি নিজের থেকে পানি না খেলে তাকে পানি খাওয়ানো যায় না। কোরিয়াতে দেখেছি, যে কোনো ধরনের যানবাহনে আরোহণের জন্য যাত্রীরা স্বেচ্ছায় লাইনে দাঁড়ান। ফুড ওয়েস্ট কিংবা গার্বেজ সঙ্গে নিয়ে লোকজন ঘুরে বেড়ায় কিন্তু নির্ধারিত স্থান ছাড়া যত্রতত্র তা ফেলে না। এটা তারা নিজেরাই করে, কেউ বলে দেয় না। হ্যাঁ, আইন তো আছেই, কিন্তু নাগরিকরা আইন মেনে চলে এবং এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অথচ দেশটির উন্নতির ইতিহাস বেশি দিনের নয়। আমাদেরও আইন আছে, আমরা আইন মেনে চলি না, আইন প্রয়োগ করি না। আমি আইন না মানলে আমাকে জোর করে আর
কতটা মানানো যাবে?
দেশের নানা ঘটনায় একটা সময় অনেক কষ্ট পেতাম, এখন আর পাই না। দেশের কোনো দুঃসংবাদে তাৎক্ষণিক কষ্ট পাই, পরক্ষণেই ভুলে যাই। ১১ জুলাই মিরসরাইয়ে ৪১ স্কুলছাত্রের জীবনাবসান কিংবা পহেলা জুলাই চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৫ জনের প্রাণহানিতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমি আমার দৈনন্দিন কাজ করছি, খাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি। কারণ কষ্ট বহনের মতো আর কোনো জায়গা আমার বুকে খালি নেই। আমি আর ভার বহন করতে পারছি না। আমার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। আর কতকাল আমি এসব দৃশ্য দেখে যাব! আর কতকাল স্বজন হারানোর আহাজারি শুনে চোখের পানি ফেলব! আমার চোখ শুকিয়ে গেছে। মিরসরাইয়ের স্কুলছাত্রদের কচি মুখখানি যখন চোখের সামনে ভাসে তখন বোবার মতো কেবল অপলক তাকিয়ে থাকি। জগতের সবচেয়ে ভারী বস্তু হচ্ছে পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ!
মিরসরাইয়ে কেন এমনটা ঘটল? ছাত্ররা কি পশু কিংবা পণ্য ছিল যে তাদের ঠাসাঠাসি করে ট্রাকে যাতায়াত করতে হয়েছিল? শিক্ষার্থীদের সঙ্গীয় শিক্ষকরা কি করেছিলেন? চালকের আসনে যখন চালকের সহকারী ছিল এবং সে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল তখন সঙ্গীয় শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেননি কেন? নাকি সঙ্গে কোনো শিক্ষকই ছিলেন না? এক ট্রাক পণ্যবোঝাই করে বাড়ি পাঠানো হচ্ছিল? ট্রাকের চালক বা সহকারী নিজেও তো আমাদের মতোই মানুষ, এ দেশেরই নাগরিক, এদেরও সন্তান আছে, পরিবার-পরিজন আছে তবুও তারা কেন এমন করবে? ট্রাফিক আইন অমান্য কিংবা বেআইনি কাজ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই-বা কী করে? সব প্রশ্নের উত্তর একটাই। আমরা এসবে অভ্যস্ত, আমরা নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত এর পরিবর্তন চাই না। শুধু ১১ জুলাইয়ের পত্রিকার পাতায়ই এ রকম অনেক সড়ক দুর্ঘটনার (!) খবর ছিল।
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১৫ জন যে মারা গেল এর দায় কার? প্রথমত দায়টা তার, যে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি জেনেও বসবাস করছে। সে কেন পাহাড়ের পাদদেশে ঘর বানাবে? এরপর আসে সমাজের, রাষ্ট্রের দায়। তারা যখন ঘর বানায় তখন কেউ তাদের ঘর বানাতে বাধা দেয়নি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরও একটাই। আমরা মরতে চাই, আমরা মারতে চাই, আমরা এমনই থাকতে চাই। যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো হয়। কে ওঠে? আমরাই তো উঠি। যে মরে, সে নিজেই তো অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে উঠেছিল, কিংবা অতিরিক্ত যাত্রী হতে অসম্মত ছিল না। আবার যার যানবাহন সেও তো আমাদের মতোই। সেও জানে, মরলে মরব, বাঁচলে বাঁচব। একইভাবে নৌকাডুবি-লঞ্চডুবি হয়। এসব ঘটনায় রাষ্ট্র্রের দায় আছে। কিন্তু সবার আগে দায়টা আমার। আমি কেন ঝড়ো হাওয়ায় বোঝাই করা লঞ্চের যাত্রী হচ্ছি? আমি দুনিয়ার সব বুঝি, আমি ইভ টিজিং করতে পারি, আল্লাহ-রসুল-শ্রীকৃষ্ণ-যিশুর জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি, সন্তান জন্ম দিতে পারি, বউ পিটিয়ে পুরুষত্ব জাহির করতে পারি, লাভ-ক্ষতির হিসাব বুঝি, রাজনীতি-অর্থনীতি সবই বুঝি, শুধু বুঝি না ট্রাক মানুষের জন্য বাহন নয়, শুধু বুঝি না পাহাড়ের পাদদেশে মানুষের বসতি স্থাপন উচিত নয়, শুধু বুঝি না যানবাহনে ঝুলে যাওয়া কিংবা অতিরিক্ত হিসেবে আরোহণ উচিত নয়। কারণ আমাদের মরিবার সাধ হয়।
ভূমিধস, নৌকা-লঞ্চডুবি কিংবা সড়ক দুর্ঘটনাকে আমি দুর্ঘটনা বলতে রাজি নই। এসব ঘটনা অবহেলা এবং নিয়মকানুনের প্রতি অবজ্ঞার কারণে ঘটে। কারণ প্রতিটি ঘটনায় কোনো না কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঘটনার আগেই সমাধান করা যেত। কিন্তু আমরা জেনেশুনেই যখন মৃত্যুর ঝুঁকি নিই তখন সেটা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা হয় না। কারণ আমরা তো আগে থেকেই জানি একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তবুও আমরা সাবধান হই না। যে ঘটনার কোনো সুস্পষ্ট কার্যকারণ আগে থেকে জানা থাকে না বা পরেও স্পষ্টভাবে জানা যায় না সেটাই হচ্ছে দুর্ঘটনা।
দেশে অবশ্যই আইন আছে, তবে আইনের প্রয়োগ নেই। যে মানার সে মানে না, যে মানানোর সে মানায় না। প্রতিদিন অগুনতি মানুষ নানা কারণে প্রাণ হারায়। রাষ্ট্র্র নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ আমরা মানুষ নই। আমাদের জীবন মানুষের জীবন নয়, আমাদের জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের। মানুষের জীবনের সঙ্গে তার দেখা হয় না। তাই রাষ্ট্র্র আমাদের অবহেলা করে, আমরাও প্রতিবাদ করি না। কারণ আমরা তো মরতে তৈরিই থাকি, মরণ ফাঁদে জেনেশুনেই পা দেই। ফড়িঙেরা যেখানে-সেখানে মরে পড়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পতঙ্গেরও পাখা গজাবে মরিবার সাধে। তাই আমরা মরণের ঝুঁকিতেই অতিরিক্ত বোঝাই করা সমুদ্রযানে কিংবা যানবাহনে অতিরিক্ত হিসেবে আরোহণ করি, ছাদে উঠি, হ্যান্ডেলে ঝুলে যাই। রাষ্ট্র্রেরও আমাদের মরণে মাথাব্যথা নেই। আছে শুধু শোক প্রকাশ, দাফনের আর্থিক সহযোগিতা আর বল্গ্যাক বেঙ্গল গোট ক্ষতিপূরণ। আমরা শোক কর্মসূচি ঘোষণা করি আনুষ্ঠানিক বিলাপ করার জন্য। কিন্তু এই বিলাপ আর কতকাল? আমি কি বিলাপ করব? আমার তো অশ্রুশূন্য চোখ, কষ্টের পাথরচাপা বুক। আমি চাই এসব বন্ধ হোক, পতঙ্গেরা মানুষের জীবনের দেখা পাক।

মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানী :শিক্ষার্থী, দং-ই ইউনিভার্সিটি, বুসান, কোরিয়া
rabbani_che@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.