কালের পুরাণ-তাহেরের বিচার অবৈধ, খালেদ হত্যা বৈধ হবে কেন? by সোহরাব হাসান

সম্প্রতি হাইকোর্টে কর্নেল আবু তাহেরের বিচারকে অবৈধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক পক্ষ রায়কে স্বাগত জানালেও অন্য পক্ষ উদ্দেশ্যমূলক বলে অভিহিত করেছে। এই নিবন্ধে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে তৎকালীন রাজনীতির একটি বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।


এ ব্যাপারে পাঠকের ভিন্নমত থাকলে তা-ও প্রকাশ করা হবে। বি. স.

১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক আদালতে যে বিচারের মাধ্যমে কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, সেই বিচারকে সম্প্রতি উচ্চ আদালত অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন, সে কথা আমরা জানি। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের অপহূত মর্যাদাও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ রায়ের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরের কথিত সিপাহি বিপ্লব সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হয়েছে বলা যাবে না। আদালতের রায়ে বিচারপ্রার্থীরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও আরেক পক্ষ তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
তাহেরের বিচার-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আদালতের মন্তব্য এবং সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। স্বীকার করতে হবে, বিচার-প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত ও গোপন। তার চেয়েও বিচারে দুটি গুরুতর বিচ্যুতি ছিল। এক. বিচারের সময় তাহের বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন, অতএব সামরিক বিধি তাঁর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। দুই. যে আইনে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন। ২১ জুলাই তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার পর ৩০ জুলাই আইনটি সংশোধন করা হয়।
সে ক্ষেত্রে তাহেরের বিচারটি যে প্রহসনমূলক ছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু আদালত তাহেরকে বিচার থেকে খালাস দিলেও ৭ নভেম্বরকে খালাস দেননি। কী ঘটেছিল সেদিন, বিপ্লব, না পাল্টা অভ্যুত্থান? কারা ঘটিয়েছিলেন? কর্নেল তাহের এবং জাসদের পক্ষ থেকে একে সিপাহি জনতার বিপ্লব বলে দাবি করা হয়। বিএনপি পালন করে জাতীয় সংহতি দিবস হিসেবে। আজ তাহেরের অনুসারী ও জিয়ার অনুসারীরা যেমন মুখোমুখি অবস্থানে, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কিন্তু তাঁরা তা ছিলেন না। তথ্যপ্রমাণে দেখতে পাই, সেদিন তাঁদের ভাষায় সিপাহি জনতার বিপ্লব কিংবা জাতীয় সংহতি ঘটেছিল দুই পক্ষের অভিন্ন শত্রু সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে। কেন? ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের চোখে তাঁরা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক। তাঁরা সম্প্রসারণবাদী রুশ এবং আধিপত্যবাদী ভারতের মিত্র। এ কারণেই কয়েক দিনের ব্যবধানে তাহেরের চার অনুসারী ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করতে গিয়ে দেহরক্ষীর হাতে প্রাণ হারান। কী বালখিল্য বিপ্লব!
৭ নভেম্বরের নায়কেরা ১৫ আগস্টের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বললেও অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে যখন খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটালেন, তখনই আরেকটি বিপ্লবের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। অন্যদের সাক্ষ্য আমলে না নিয়ে দেখা যাক কর্নেল আবু তাহের এ সম্পর্কে কী বলেন। আমরা আদালতের দেওয়া তাঁর শেষ জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘ওই দিন (৩ নভেম্বর) বহু সেনাসদস্য, এনসিও এবং জেসিও আমার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে এলেন। তাঁরা আমাকে জানালেন, ভারত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে এবং বাকশালের সমর্থকেরা আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।’ এরপর তিনি বলছেন, ‘৩ নভেম্বরের পর জাতি কী ভয়ংকর ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা কারোরই অজানা নয়। আমাদের জাতীয় সম্মান ও সার্বভৌমত্ব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময় জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ভারত খালেদ মোশাররফকে মদদ দিচ্ছিল।’ (আদালতে দেওয়া জবানবন্দি, জুন ১৯৭৬, সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ মার্চ, ২০১১)
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর সেনানিবাসের ভেতরে ও বাইরে কেউ একটি গুলি ছুড়েছে, কিংবা কেউ কারও হাতে নিহত হয়েছে—এ দাবি তাঁরা করতে পারবেন না। তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হলো কীভাবে? ১৫ আগস্ট রশীদ-ফারুক চক্র সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন না ৭ নভেম্বরের কুশীলবেরা। তাঁদের সঙ্গে ফারুক-রশীদ চক্রের একেবারে যোগাযোগ ছিল না, তাও বলা যাবে না। কর্নেল রশীদের একজন প্রতিনিধি ফোনে মুজিব হত্যার খবর দিয়ে তাহেরকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে যেতে বলেছিলেন। তাহের সেখানে গিয়েছিলেন। তাহেরের ভাষ্য: ‘আমি তখন রেডিও চালিয়ে দিয়ে জানতে পেলাম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন। এ খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলো, এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘মোশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প উপহার দিতে পারেনি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু রুশ-ভারতের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। সত্যিকার অর্থে দেশ বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়েছিল।’ (সূত্র: অসমাপ্ত বিপ্লব, লরেন্স লিফশুলজ, বাংলা ভাষান্তর)
দেশ যখন বেসামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে ছিল, তখন সেই সরকারের পতন ঘটাতে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ডাক দিল তাহেরের দল। কিন্তু সামরিক একনায়কতন্ত্রের আমলে কিছুই করল না, কেবল দর্শকের মতো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল। জাসদ নেতারা সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রধান সেনাপতি জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চললেন।
মুজিব হত্যায় জাসদ ও কর্নেল তাহেরের কী ভূমিকা ছিল, তা আজও রহস্যাবৃত। এ ব্যাপারে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন, ‘মুজিব উৎখাতের কয়েক মাস আগে থেকে জাসদ এক গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সাবেক সৈনিক সমবায়ে গঠিত বিপ্লবী গণবাহিনী ও কার্যরত সৈনিকদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা—জাসদের এই দুই সশস্ত্র শাখা নিয়ে গোপন সামরিক অধিনায়ক তাহেরের নেতৃত্বে এই প্রস্তুতি চলছিল।’ (অসমাপ্ত বিপ্লব, লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ১৯)
জনগণকে বাদ দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির এমন নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না জানা নেই। দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের অসংখ্য উদাহরণ আছে। বাংলাদেশেও পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সে রকম একটি প্রাণঘাতী সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। কর্নেল তাহের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে খালেদ মোশাররফকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও খন্দকার মোশতাকের নিয়োগপ্রাপ্ত বিমানবাহিনীর প্রধান এম জি তোয়াবের ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার পর তিনি ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে যে বৈঠকে মিলিত হন, তাতেও এম জি তোয়াব ও মাহবুব আলম চাষী উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী নেতাদের সঙ্গে তাহেরের বৈঠকে খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, দলমত-নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তিদান, রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, বাকশাল বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই ১২ দফার কোথাও জনগণের মুক্তির কথা নেই। তাহলে বিপ্লবের উদ্দেশ্য কি শুধু সেনানিবাসের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছিল?
কর্নেল তাহের কিংবা জাসদ যে সর্বদলীয় ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ গঠন করতে চেয়েছিলেন, তাতে দল হিসেবে বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি—এই ঘরানার কারও স্থান ছিল না। তারা কি জনগণের কোনো অংশের প্রতিনিধিত্ব করত না? তাদের কি কোনো জনসমর্থন ছিল না? ছিল। কিন্তু ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের কাছে বাকশাল ছিল জাতীয় শত্রু, এমনকি ফারুক-রশীদ চক্রের চেয়ে ভয়ংকর বিপজ্জনক। এই ছিল তাঁদের ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের’ স্বরূপ।
২ নভেম্বর রাতে জেলখানায় যে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো, সে সম্পর্কে তাহের ও জাসদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে ৭ নভেম্বরের আগে বিবিসির ঢাকা সংবাদদাতা আতিকুল আলম খবর প্রচার করলেন যে ভারতীয় হাইকমিশনারকে লেখা তাজউদ্দীন আহমদের একটি চিঠি তাঁর হাতে আছে। যে চিঠিতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান সফল করতে ভারতের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি সেই চিঠি দেখাতে পারেননি। (সূত্র: অসমাপ্ত বিপ্লব, লরেন্স লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ৬৬)। কথিত এই চিঠি ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ঘৃতাগ্নি হিসেবে কাজ করে। সিপাহিরা স্লোগান তোলেন ‘রুশ-ভারতের দালালদের খতম করো।’ খালেদ মোশাররফ কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ‘রুশ-ভারতের দালাল’ হিসেবে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। এর দায় ৭ নভেম্বরের কুশীলবেরা এড়াবেন কীভাবে?
৭ নভেম্বরের ঘটনাকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব বলে দাবি করেছেন কর্নেল তাহের ও তাঁর সমর্থকেরা। জিয়াউর রহমান বুর্জোয়া সামরিকব্যবস্থার প্রতিনিধি। তাহের গণবাহিনীর প্রবক্তা। তাহলে এই দুই শক্তির সম্মিলন ঘটল কীভাবে? সম্মিলন ঘটার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে আওয়ামী বাকশালীদের তাড়ানো। এই আওয়ামী বাকশালীদের যে অংশ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কাতারবন্দী হয়েছিল, তাদের ব্যাপারে ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের তেমন আপত্তি নেই। আক্রোশ কেবল খালেদ মোশাররফের ওপর। এটি ছিল ক্ষমতার লড়াই এবং সেই লড়াইয়ে ৭ নভেম্বর জিয়া-তাহের এক পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হন। লড়াইয়ে জিয়া জয়ী হয়েছিলেন বলে তাহেরকে জীবন দিতে হয়েছে। তাহের জয়ী হলে জিয়ার পরিণতিও ভিন্ন কিছু হতো না।
জাসদ নেতাদের একাংশ মনে করেন, তাঁরা বিপ্লবটি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছিলেন, জিয়ার ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য হাতছাড়া হয়ে যায়। জাসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বিশেষ সামরিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত আ স ম আবদুর রব কিন্তু এ নিয়ে এখন একটি কথাও বলেন না। তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক শাজাহান সিরাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘বস্তুত ৭ নভেম্বরে আমরা কী করতে চেয়েছিলাম, তা জনগণ জানত না। কারণ আমাদের দিক থেকে এ সম্পর্কে কোনো ধারণা জনগণকে দেওয়া হয়নি।’ (রাজনৈতিক রিপোর্ট, ১৯৮০)। সাবেক জাসদ নেতা মাহবুবুর রহমান সাদী আত্মসমালোচনার সুরে বলেছেন, ‘..কিন্তু ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে, বিপ্লবী কৃতিত্ব তো দূরের কথা, বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে আমাদের নৈরাজ্যবাদী অপকীর্তির জন্য দায়ী থাকতে হবে।’ (বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, ১৯৮০)
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে রুশ-ভারত কিংবা দেশের ভেতরেরও কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন কর্নেল শাফায়েত জামিল। তিনি লিখেছেন, ‘৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার, সংবিধানবহির্ভূত অবৈধ সরকারের অবসান এবং একজন নিরপেক্ষ সৈনিকের অধীনে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। ...৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি দেশের ক্ষমতা দখল করতে চাননি এবং করেনওনি। পর পর অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব নিয়ে রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিতে চাননি। ক্ষমতা দখলের লোভ থাকলে তিনি সেটা অনায়াসেই করতে পারতেন।’
আমরা কোনো মৃত ব্যক্তিকে সাক্ষী মানছি না। মেজর (অব.) হাফিজ (বর্তমানে বিএনপি নেতা) ও শাফায়েত জামিল এখনো বেঁচে আছেন। ৭ নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে তাঁদেরসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিস্তারিত জানা যেতে পারে। শাফায়েত জামিল বই লিখেছেন। মেজর হাফিজ লিখলে আরও কিছু অজানা তথ্য দেশবাসী জানতে পারবে। ৭ নভেম্বর সম্পর্কে যেসব মিথ বা কল্পকথা আছে, তারও অবসান হবে।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সংঘটনকারীরা শুধু সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেননি, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রীকেও হত্যা করেছেন, হত্যা করেছেন একজন নারী চিকিৎসককে। এর দায় কীভাবে এড়াবেন বিপ্লবের প্রবক্তারা? তাঁরা একদল সিপাহিকে অফিসারদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন। অফিসার মানে ‘বুর্জোয়া’ হলেও সিপাহি মাত্রই বিপ্লবী নয়। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড তারই প্রমাণ।
বাংলাদেশে যেকোনো অঘটন, দুর্ঘটনাকে বিপ্লব বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা আমাদের রাজনীতিকদের আছে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন সরকারও কথায় কথায় ‘বিপ্লব’ ও ‘বাদ’-এর তত্ত্ব হাজির করেছিল। তাহেরের বিপ্লব আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলতে চাই, ৭ নভেম্বরের ঘটনা সমাপ্ত বা অসমাপ্ত বিপ্লব নয়, ইতিহাসের দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
তাহেরের বিচারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়ে উচ্চ আদালত সেই সময়ে শত শত মুক্তিযোদ্ধা হত্যার ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা আশা করব, সরকার শিগগিরই এ ধরনের একটি কমিটি গঠন করে দ্রুত কাজ শুরু করবে। সেই সঙ্গে এও প্রত্যাশা থাকবে, তথ্যানুসন্ধানের কাজটি ৭ নভেম্বর থেকেই শুরু হবে। কারা সেদিন বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অফিসারদের হত্যা করেছেন? কারা সিপাহি বিপ্লবের নামে তাদের উসকে দিয়েছিলেন? কারা শেরেবাংলা নগরে আশ্রয়গ্রহণকারী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দারকে হত্যা করেছিলেন? ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনের জন্যই এসবের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তাহেরের গোপন বিচারকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করে তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু খালেদ মোশাররফের ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে না কেন? বিচার না হওয়া মানে হত্যাকে বৈধতা দেওয়া।
পরের কিস্তি জাসদের রাজনীতি: না সমাজতন্ত্র, না বিপ্লব
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.