বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অফিস কি তুলে দেওয়া উচিত? by মামুন রশীদ

অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরুদ্ধে কিছু দিন পরপর অভিযোগ ওঠে। আইএমএফ তাদের সম্প্রসারিত ঋণ সহায়তার আওতায় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার না দেওয়ায় এবং ওই অর্থ ছাড়করণে অনেক শর্ত আরোপ করায় দেশের


অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ সম্প্রতি সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এ ধরনের অভিযোগ আমরা অনেকবার আগেও শুনেছি। মজার ব্যাপার হলো, এসব অর্থনীতিবিদ সবাই প্রায় একই চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী যাঁরা মনে করেন, আমরা যেভাবে আমাদের 'স্বাধীনতা যুদ্ধ' করেছি ঠিক সেই চেতনাতেই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্যও অর্থ সংগ্রহ করা উচিত। তাঁরা এও মনে করেন যে আমাদের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দেওয়া 'প্রেসক্রিপশন'টা প্রতীকী ও ত্রুটিপূর্ণ। সে জন্য সংস্থা দুটিকে আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।
এই অবস্থায় সম্ভবত আমাদের এখন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভূমিকা মূল্যায়ন করা দরকার। একই সঙ্গে সংস্থা দুটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বৈধতা বা যৌক্তিকতাও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। জাতি হিসেবে অবশ্য আমরা অতীতে বারবার নিজেরাই নিজেদের পরাজয় বা বদনামের গ্লানিতে ডুবিয়ে দুর্নীতি, রাজনৈতিক সংঘাত, সামাজিক অবিচার ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মতো অসম্মানজনক বিষয়গুলোতে 'চ্যাম্পিয়ন' হয়েছি। সে জন্য আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশকে সহায়তা করতে সচেষ্ট থাকা এই দুটি সংস্থাকে (বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ) জড়িয়ে একই ভুল যাতে আর না হয় সেটি নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকে যোগ দেয়। সংস্থাটি প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন, জরুরি ভিত্তিতে পানীয়জল সরবরাহ এবং এ দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার কাজে সহায়তা করে। বিশ্বব্যাংকের সহজ শর্তে ঋণপ্রদানকারী অঙ্গসংস্থা আইডিএ (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি) ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ২০০টি প্রকল্পে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ-সহায়তা দিয়েছে। বিগত শতকের সত্তরের দশকে এই সংস্থা বাংলাদেশকে কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে এবং এতে বাংলাদেশ খাদ্য সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে সহায়তা দেয়। এর ফলে বাংলাদেশে জন্মহার কমার ক্ষেত্রে নাটকীয় উন্নতি ঘটে।
অনেকেই মনে করতে পারেন, আমি এমবিএর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকা এসব ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশন্সের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত করেছি। একজন অর্থনীতির ছাত্র বা নীতি বিশ্লেষক হিসেবে আমি মনে করি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যদি অর্থনৈতিক চাহিদার পরিস্থিতিতে সুদের হার বাড়ানো বা কমানো, সুশাসনের উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারিকরণ, দুর্নীতি নির্মূল, দরিদ্রদের ঋণ প্রদান, ভর্তুকি নির্ভরতা হ্রাস এবং বেসরকারি খাত জোরদার করা উচিত বলে পরামর্শ দেয় তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই।
বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এটি সাধারণ ব্যাংকগুলোর মতো নয়। এটি বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মালিকানাধীন দুটি অনন্য প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (আইডিএ) সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশ্বজনীন প্রতিষ্ঠান। দুটি প্রতিষ্ঠানই (আইবিআরডি ও আইডিএ) আলাদাভাবে কাজ করলেও বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে আইবিআরডি মধ্যম আয়ের ও ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত গরিব দেশগুলোকে আর আইডিএ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে গুরুত্ব দেয়। উভয় প্রতিষ্ঠানই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, যোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে স্বল্পহার সুদে ও বিনা সুদে ঋণ প্রদানের পাশাপাশি অনুদানও দিয়ে থাকে।
আইএমএফের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়- বিনিময় হার ও আন্তর্জাতিক পেমেন্ট বা পরিশোধ ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। যাতে দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে পণ্য ও সেবা কেনাবেচা করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও সংকট প্রতিরোধে আইএমএফ জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ও আর্থিক উন্নয়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে। এই সংস্থা তার ১৮৭টি সদস্য দেশকে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা জোরদারকরণ, অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংকটের ঝুঁকি হ্রাস, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে নীতিমালা গ্রহণে পরামর্শ দেয়। এর পাশাপাশি আইএমএফ তার সদস্য দেশগুলোর নেওয়া নীতিমালার জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফলাফল পর্যালোচনার ফোরাম হিসেবেও কাজ করে। এ ছাড়াও আইএমএফ সদস্য দেশগুলোতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে সংকট দেখা দিলে, পরিশোধের পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে ছাড়িয়ে গেলে ও মজুদ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে সেগুলো মোকাবিলায় সাময়িকভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
তবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সদস্য দেশগুলোকে বা ঋণগ্রহণকারী দেশগুলোকে সব সময় সহায়তা না করা, একই কৌশল বা ফর্মুলা সবার জন্য প্রয়োগ করা অথবা সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তব পরিস্থিতি না বোঝার ট্র্যাক রেকর্ডও আছে আইএমএফের। তবে এটিই সত্য যে, সদস্য দেশগুলোর বাস্তবতায় যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি এ দুটি সংস্থাও বিকাশের পথপরিক্রমায় তাদের ঐতিহ্যগত অবস্থান থেকে অনেকটা সরে গেছে। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নির্দেশনার চেয়ে সদস্য দেশগুলোরই ঠিক করা উচিত তারা কেন ও কিভাবে সহায়তা পেতে চায়। অর্থনীতিতে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া উন্নয়ন সহায়তা ঋণ বাংলাদেশের সব খাতে সুফল না দিলেও আর্থিক খাতের জন্য বেশ ভালো ফল বয়ে এনেছে। বিশেষ করে প্রকল্পের নকশা তৈরি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এবং সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও শৃঙ্খলার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত অথবা চীন কখনোই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অফিস বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবেনি। বরং তারা নিজেদের জনগণের স্বার্থে এই দুটি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে দর কষাকষি বা সমঝোতার মাধ্যমে সম্ভব সর্বোচ্চ সহায়তা নিয়ে আসছে। বাংলাদেশের বেলায় এর ব্যতিক্রম ঘটবে কেন?
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.