মানুষের মুখ-অবাক চা পান by অলোক বসু

বাঙালি যে চা পানের বিষয়টি খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে আর কিছু না পাওয়া গেলেও এক কাপ চা পাওয়া খুব কষ্টের বিষয় নয়। খোদ রাজধানী ঢাকায় প্রতি ১০ কদমে একটি চায়ের স্টল পাওয়া বিচিত্র কোনো ব্যাপার নয়।


এ থেকে বোঝা যায়, বাঙালির বর্তমান চা-প্রীতি উল্লেখ করার মতোই। অথচ আমাদের চা পানের ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর প্রথম চা পান করেছিলেন তিব্বত ভ্রমণকালে। এরপর চা নিয়ে আর তেমন কিছু শোনা যায়নি। তবে ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজরা নাকি বাঙালিদের মধ্যে চা পানের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য হাটে-বাজারে বিনা পয়সায় চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করত। কিছুকাল আগেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজে চা পানের যতটা প্রচলন ছিল, ততটা ছিল না সাধারণ পরিবারে। এখন ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আমলা-কামলানির্বিশেষে সব বাঙালির মধ্যেই চায়ের নেশা বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। আর সে জন্যই যেখানে-সেখানে চায়ের দোকান বসে যাচ্ছে। আমরা খুব কম খরচেই একটি ভালো জিনিসের স্বাদ গ্রহণ করতে পারছি অনায়াসে। অনেকেই আছেন, যাঁরা বাড়ি কিংবা কর্মক্ষেত্রের বাইরে চা পান করেন না। এ লেখা তাঁদের জন্য নয়। আবার এমন কিছু মানুষ আছেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হরহামেশাই তাঁদের বাইরে চা খেতে হয়। আবার (আমার মতো) কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের পেটে টং দোকানের চা না পড়লে চায়ের নেশাই কাটে না।
একদিন হঠাৎই রাজধানীর মহাখালীতে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বটতলায় আবিষ্কার করি একটি আশ্চর্য টি-স্টল। বাড়িয়ে বলছি না। ‘আশ্চর্য’ বলার পেছনে রয়েছে অবাক হওয়ার মতোই কিছু কারণ। এই চায়ের দোকানের মালিকের নাম স্বপন। তাঁর চায়ের দোকানে ঝুলছে একটি ডিজিটাল ব্যানার। অবাক হওয়ার অন্যতম কারণ এটি। ব্যানারের শিরোনামে লেখা ‘স্বপন মঙ্গল চা’। এর নিচে লেখা ‘চায়ের গুণাগুণ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “চা-স্পৃহ চঞ্চল/ চাতকদল চল...”।’ এর নিচে আরও যা লেখা তা এ রকম, ‘রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের চায়ের প্রশংসা করতে গিয়ে কথাগুলো লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি বিশেষ কারো হাতের বানানো চা নিয়ে কিছু বলেননি।’ তিনি যদি স্বপনের হাতের বানানো এক কাপ আদা-চা খেতেন, তাহলে কী লিখতেন? এ রকম কথাবার্তা যেমন ব্যানারে লেখা, তেমনই ব্যানারের প্রায় অর্ধকজুড়ে খুব সুন্দর ডিজাইনে একটা কাপের ছবি। কাপ থেকে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কাপের গায়ে আবার একটি প্যানেলের ওপরের দিকে চে গুয়েভারার ছবি, নিচের দিকে স্বপনের ছবি। ব্যানারের নিচের দিকে লেখা ‘হয়ে যাক এক কাপ স্বপন মঙ্গল চা। বিপ্লবী চায়ের আমেজ’।
স্বপনের বানানো এক কাপ আদা-চা খেতে খেতে বুঝে নিলাম, আসলে তাঁর হাতের চায়ের স্বাদই আলাদা। মন-প্রাণ চাঙা করে তোলে। জানতে চাইলাম ব্যানারের কথা। জানালেন, এক বড় ভাই এটা বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর চায়ের খুবই ভক্ত। তিনি কোনো রকম খরচা না নিয়ে নিজে থেকেই ব্যানারটি বানিয়ে দিয়েছেন। আরও জানা গেল, সেই বড় ভাই নাকি প্রায়ই তাঁর বন্ধুবান্ধব-সহকর্মীদের নিয়ে দলবেঁধে এসে চা খেয়ে যান। স্বপনের চা খেতে খেতে বুঝতে পারলাম, কথাগুলো মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়। ভালো জিনিসের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য আমাদের খুব কমই হয়। তাই ভালো কিছুর সন্ধান বন্ধুবান্ধবকে দিতে পারলে নিজেকে কেমন বিজয়ী বিজয়ী মনে হয়, যেমন এখন পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরে।
সদাহাস্য মুখের অধিকারী যুবা-উত্তর বয়সী এই মানুষ চায়ের ব্যবসা করছেন ১৬-১৭ বছর ধরে। নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাড়িঘর হারিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে চাঁদপুর থেকে আসেন স্বপন। তাঁর চায়ের খ্যাতি আজ আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর চা আশপাশের চা-আমোদীদের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। অলস দুপুর কিংবা শুধু কর্মব্যস্ত ক্লান্ত বিকেলে নয়, শীতের মধ্যরাতেও চলে যেতে পারেন তাঁর দোকানে। আপনি যদি তাঁর চায়ের দোকানে প্রথমবার যান, তাহলে অবশ্যই জানিয়ে দেবেন চায়ে কেমন দুধ বা চিনি খান অথবা রং-চা খেলে লিকার, চিনি, আদা বা লেবু কেমন খান। পরিমাণটা একবার জানিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার আর কখনো আপনাকে বলতে হবে না, ‘আমার চায়ে চিনি কম কিংবা দুধ দেবেন না’। স্বপনই আপনার চাহিদা মনে রেখে সুন্দর করে গরম পানিতে মগ ধুয়ে আপনার পছন্দমতো এক কাপ চা বানিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে দেবেন আপনার হাতে। চা পানের এই বিরল অভিজ্ঞতায় আপনার চিত্ত চঞ্চল হলে তখনই আরও দু-এক কাপ চা পান করার কিংবা সুযোগ পেলেই বারবার সেখানে চলে যাওয়ার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
মনে হতে পারে, স্বপনকে নিয়ে আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে। না, চা বানানোও যে শিল্প হতে পারে, সেটা স্বপনই প্রথম নন, তাঁর আগে অনেকে প্রমাণ করে গেছেন।
যাঁরা ঢাকায় থাকেন এবং যাঁদের বাসার বাইরে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে তাঁরা জানেন, ভালো হাতের এক কাপ গরম চা পাওয়া কত দুষ্কর। দুধ, চিনি আর লিকারের মধ্যে কখনোই সৌহার্দ্য তৈরি হয় না। তা ছাড়া চা খেতে গেলে পরিচ্ছন্ন কাপে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতাও বিরল। এসব বিবেচনায় স্বপন সম্পর্কে যেটুকু বলা হলো, সেটা উৎসাহী যে কারও পক্ষে সশরীরে গিয়ে প্রমাণ করাই উত্তম।
আজকের দুনিয়া ব্র্যান্ড, স্পেশালিটি আর প্রপাগান্ডার দারুণ ভক্ত। কানিজ আলমাস, ফারজানা শাকিলদের গুণের তারিফ করতে আমরা পিছিয়ে থাকি না। তাঁদের শপে গিয়ে নিজেকে সাজিয়ে আনতে পারলে ধন্য মনে করি। মুম্বাই থেকে হাবিব ঢাকায় এলে তাঁর কাছে চুল কাটানোর জন্য কাড়াকাড়ি-মারামারি লেগে যায়। অথচ আমরা স্বপনদের খবর রাখি না। অনেক যত্ন করে আপনার পছন্দমতো এক কাপ চা আপনার হাতে এগিয়ে দেওয়ার মতো একজন স্বপন অন্তত এই ঢাকা শহরে আছে, যে আপনাকে দেবে অবাক চা পানের অভিজ্ঞতা।
aloksulok@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.