চারদিক-শহীদ সাবেরের জীবন ও জগৎ by মযহারুল ইসলাম

সময়টা পাকিস্তান আমল। এক কোরবানির ঈদের দিন। পুরানা পল্টন লেনের দাদার বাড়িতে দুপুরের দিকে শাহজাহান চাচার সঙ্গে ক্যারাম খেলছিলাম মহিউদ্দিন মন্টু ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু চাচার বেড়ার ঘরসংলগ্ন বেলিম্বুগাছের ছায়ায়। ক্যারাম খেলায় এতটাই মশগুল ছিলাম, পাশে দাঁড়ানো কারও উপস্থিতি টের পাইনি।


পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম। ময়লা, ছেঁড়া প্যান্ট-শার্ট; মাথা আর মুখে এলোমেলো চুল-দাড়ি। অপরিষ্কার হলুদ দাঁত, বড় বড় হাতের নখ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের আগুন হাতের আঙুল স্পর্শ করলেও সে দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। দেখে কিশোর বয়সে ভয় পাওয়ারই কথা। আমিও ভয় পেয়ে খেলা ছেড়ে স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত। শাহজাহান চাচার অভয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছি, তবে ভয়ে ভয়ে। লোকটি নিঃশব্দে আমাদের খেলা উপভোগ করছেন। বড়ই শান্ত ও নির্বিকার। শাহজাহান চাচা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দুপুরের খাবার এখানে খেয়েছেন কি না, জিজ্ঞেস করলে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিলেন কোনোরূপ শব্দ ও বাক্য ব্যয় না করে। লোকটির পরিচয় শাহজাহান চাচাকে জিজ্ঞেস করলে খেলায় ব্যস্ত শাহজাহান চাচা শুধু ‘মামা’ বলেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, লোকটিকে আমার একটুও ভালো লাগেনি।
এর কিছুদিন পর বাবার সঙ্গে তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউ থেকে হেঁটে পুরানা পল্টন লেনে দাদার বাড়ি যাচ্ছি। বর্তমানের হাউস বিল্ডিং অতিক্রম করছি, হঠাৎ সেই পাগল লোকটি আমার বাবাকে মৃদু স্বরে ‘মামা’ ‘মামা’ বলে পথ আগলে দাঁড়ান। আমার বাবা ‘আরে সাবের, কেমন আছো?’
আমার বাবা বিষণ্ন চোখে লোকটির এই দ্রুত চলে যাওয়া বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলেন। বাবাকে লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বাবা ওই চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে চেয়েই বিষণ্নভাবে বললেন, ‘খাদ্যরসিক, ভোজনবিলাসী সালামত উল্ল্যাহ নানার কথা শুনিস নাই? আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন। সালামত উল্ল্যাহ নানার বড় ছেলে সাবের।’
১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার ঈদগাওর সোনাপুকুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম এবং ঈদগাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় মাকে ছেড়ে পিতার কাছে সৎমায়ের সংসারে কলকাতায় চলে যান। কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়ে বরাবরই ক্লাসের সেকেন্ড বয় হিসেবে পরিচিত পান। ছন্দ শিখা নামের হাতে লেখা পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে সপরিবারে তাঁরা পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন সাবের। আইএ ক্লাসের ছাত্র শহীদ সাবের ১৯৫০ সালে ছাত্র ফেডারেশনের এক সমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না দিয়ে নিরাপত্তা-বন্দী শহীদ সাবেরকে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরে তাঁকে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম জেলে বসেই বন্দিজীবনের কাহিনি নিয়ে লিখেছিলেন ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ নামক রোজনামচা। লেখাটি গোপনে জেল থেকে পাচার হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নতুন সাহিত্য-এর চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়েছিল। বিএ পাস করে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে তাঁর মানসিক বিপর্যয় শুরু হয়।
নিজের অবস্থানে টিকে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় জীবনের প্রতি তীব্র অনীহা কিংবা ঘৃণায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান শহীদ সাবের। তাঁর সেই মানসিক বিপর্যয়কালে সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে সেই সুস্থতা বজায় থাকেনি। পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। নোংরা ও অপরিষ্কার থাকা তাঁর মজ্জাগত হয়ে যায়। বেগম সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুন তাঁকে পরিচ্ছন্ন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নিজের বাড়িতে নিয়েও রাখতে পারেননি। ফাঁকি দিয়ে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। তাঁর জীবন হয়ে পড়ে অসংলগ্ন এবং প্রথাবিরোধী।
বংশালের সংবাদ অফিসই হয়ে উঠেছিল সাবেরের একমাত্র আশ্রয়স্থল। দিনময় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে রাতে ঘুমাতে যেতেন সংবাদ অফিসে। মেঝে, বারান্দা, হাতলবিহীন চেয়ার ছিল তাঁর ঘুমের স্থান। সংবাদ অফিস থেকে তাঁকে প্রতিদিন দুই টাকা দেওয়া হতো। প্রেসক্লাবে খাওয়া ফ্রি। ফ্রি খাওয়ার বেলায়ও ছিলেন অনিয়মিত। সিগারেট, একমাত্র সিগারেট খেতেই সবার কাছে হাত পাততেন নির্দ্বিধায়। জীবনের বোঝা বয়ে বয়ে উদ্ভ্রান্ত জীবনে অভ্যস্ত শহীদ সাবের মূলত বন্ধুদের সাহায্যেই বেঁচে ছিলেন মাত্র। ছিল না বোধ; ছিল না স্বপ্ন পূরণের সামান্য মানসিক শক্তি। কেউ খাওয়ালে খেতেন, নয়তো না খেয়েই থাকতেন। অনাহার ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রগতিশীল ও জাতীয় চেতনার দৈনিক সংবাদ অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সংবাদ অফিসের স্থায়ী বাসিন্দা ঘুমন্ত শহীদ সাবের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। তাঁর দেহের সৎকার তো দূরের কথা, শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। পুরো সংবাদ অফিসের সঙ্গে ছাই-ভস্ম হয়ে যান দৈহিকভাবে বেঁচে থাকা শহীদ সাবের।
শহীদ সাবেরের রচনাসমূহের মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ রোজনামচা আরেক দুনিয়া থেকে (১৯৫৭), ছোটগল্পগ্রন্থ এক টুকরো মেঘ (১৯৫৫), ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান (১৯৫৮), অনুবাদগ্রন্থ পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগলের পাগলের ডায়েরী, ক্যাথারিন ওয়েন্স পিয়ারের কালো মেয়ের স্বপ্ন (১৯৫৮)। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন দৈনিক ও পত্রপত্রিকায় তাঁর অনেক কবিতা ছাপা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে (মরণোত্তর) বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেছিলেন শহীদ সাবের।

No comments

Powered by Blogger.