ব্যাংকে তারল্যসংকট-২-ঋণ নিয়ে অপচর্চার জেরে পণ্য মজুদ হচ্ছে, বাড়ছে দাম by মনজুর আহমেদ

৯০ দিনের আস্থার বিপরীতে ঋণ (লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট—এলটিআর) আদায়ে ব্যাংকগুলোর তৎপরতা জোরালো নয়। আর এ সুযোগে নিত্যপণ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের একাংশ তাঁদের মালামাল গুদামে মজুদ রাখেন দীর্ঘদিন ধরে। এতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে না। তাই সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি হতে থাকে বাজারে।


তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামার কারণে তাঁরা বড় লোকসান দিচ্ছেন। আর লোকসান কিছুটা কমাতে ব্যবসায়ীদের অল্প সময় মালামাল ধরে রাখতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এলটিআর ঋণ শর্তে যে নিয়মনীতি ছিল, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এর জায়গায় নতুনভাবে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মুনাফা করার অপেক্ষা’ বা ব্যবসায়ীদের ভাষায়, ‘লোকসান কমানোর জন্য’ পণ্যের মজুদদারি।
নিত্যপণ্যের বছর বছর মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, একধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধান এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যবসায়িক সূত্রগুলো থেকেও পাওয়া গেছে বিচিত্র সব তথ্য। এলটিআর ঋণনির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদায় না হওয়ার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসূত্রতারও অভিযোগ আছে।
নিয়ম হলো লিম (লোন এগেইনস্ট ইমপোর্টেড মার্চেন্ডাইজ) অর্থায়ন করা পণ্যের ওপর ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কিন্তু থাকছে না। পণ্য গুদামে থাকুক বা না থাকুক, ব্যাংক তার টাকা ফেরত পাচ্ছে না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয় ঋণপত্র বা এলসি খুলে আমদানিকারক পণ্য বিক্রি করেন, কিন্তু তা বাজারে আসে না। এতে কেবল এক গুদাম থেকে মালামাল আরেক গুদামে গিয়ে ওঠে। কিন্তু ব্যাংকের টাকা ঘরে ফেরে না। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরই আরেক প্রতিষ্ঠান দিয়ে পণ্যটি স্থানান্তর দেখানো হয় স্থানীয় ঋণপত্রের মাধ্যমে।
দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নূরজাহান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহির আহম্মেদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এলটিআর ঋণ মেয়াদি ঋণে পরিণত করতে হচ্ছে কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘ধরেন, তেলের আমদানি মূল্যের চেয়ে দেশের বাজারে দাম কম ছিল। ফলে প্রথম দিকে বিক্রি করতে পারেনি। পরে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। দাম যা পাওয়া গেল, তা দিয়ে ব্যাংকের সব দায় পরিশোধ হয় না। সে কারণে পুনঃ তফসিল করতে হচ্ছে।’
ব্যাংকের নগদ টাকা কোথায় গেল, কেনই বা তারল্যসংকট—এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঢাকার বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, মৌলভীবাজার, বাবুবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদে দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বতালাশ এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ অপব্যবহারের বিচিত্র সব তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, ব্যাংকের ৯০ দিনের অর্থায়নে আমদানি করা পণ্য মজুদ হয়ে থাকে ব্যবসায়ীর গুদামে। এতে একদিকে টাকা আটকে যাচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে পণ্য মজুদ, যার সঙ্গে দেশের বাজারে মূল্য-পরিস্থিতির পরিষ্কার সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, এলটিআরের মেয়াদি ঋণে পরিণত হওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এসেছে। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনেক দিন ধরে এটা চলে আসছে। এক দিনে এর সুরাহা করা যাবে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই এর সুরাহা করবে।
ব্যাংক অর্থায়নে বৈচিত্র্য ও অপচর্চা: আমদানি সহায়তা নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করার তথ্য ব্যাংকগুলোতে আগেও ছিল। কিন্তু দুই-তিন বছরে এ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এগুলো সরেজমিন এবং ঢাকায় ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কথা বলতে চান না। দেখা গেছে, এলটিআরের যে ঋণ মেয়াদি ঋণে পরিণত হচ্ছে, পরে তা আবার খেলাপিও হয়। এ খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। পুনঃ তফসিলের সময় সুদ মওকুফ হয়। কিন্তু এর অনেক আগেই মালামাল বিক্রি হয়ে যায়।
একজন ব্যবসায়ী ডাল আমদানির একটা উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, এক বছরের বেশি সময় বিপুল পরিমাণ ডাল গুদামে রেখে দেওয়া হয়। এতে কিছু ডাল নষ্ট হয়। সেগুলো পরে ভেঙে বেসন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হয়। বাকি ডাল বাড়তি বাজারমূল্যে বিক্রি হয়। সেখানেও লাভ হয় বড় অঙ্কের। ইতিমধ্যেই আমদানি ঋণ মেয়াদি ঋণে পরিণত হয়েছে। মেয়াদি ঋণও খেলাপি হয়। পরে আবার বড় অঙ্কের সুদ মওকুফও নেওয়া হয়।
স্থানীয় ঋণপত্র (লোকাল এলসি) ব্যাংকের আরেক ধরনের আমদানি অর্থায়ন। আমদানিকারক তাঁর পণ্য আরেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির জন্য এ এলসি নেন। ব্যাংকভেদে আইবিপি নামে এটা পরিচিতি। সোনালী ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে এ আইবিপি ছিল এক হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, আর ১৫ ফেব্রুয়ারি এর পরিমাণ হয়েছে এক হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।
ব্যাংক ও ব্যবসায়িক সূত্রগুলো বলছে, এগুলো সবই পণ্য বাজারজাতকে প্রলম্বিত করে। এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সদস্য ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী কিছু সত্যতা থাকতে পারে বলে স্বীকার করেন। তবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে আমদানিকারকেরা কীভাবে লোকসান দিয়েছেন, তার কিছু তথ্য-প্রমাণ দেখান। ব্যবসায়ী এই নেতা বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী সাম্প্রতিক সময়ে কীভাবে লোকসান দিয়েছে এবং তার পরিণতিতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা কী হতে পারে, তা বর্ণনা করেন। আন্তর্জাতিক ও দেশের বাজার-পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই অবস্থা হয়েছে বলে তিনি মত দেন।
ঋণপত্রে এফডিআর আর নগদ জমা: বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি হচ্ছে, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যাংকগুলোকে আমদানিকারকের কাছ থেকে নগদ কিছু টাকা নিতে হবে। যাকে বলা হয় এলসি মার্জিন। কিন্তু হরহামেশা দেখা গেছে, ব্যাংক বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ নেয়। আর বড় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী জমা দেন এফডিআর (স্থায়ী আমানতের প্রমাণাদি)। এ এফডিআরের ওপর ব্যবসায়ী বর্তমান হার অনুসারে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ পান। অন্যদিকে যিনি নগদ অর্থ দেন তাঁকে হয় অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করে দিতে হয়, না হলে নিজের টাকা দিতে হয়। ঋণ হলে তার সুদ অন্তত ১৫ শতাংশ। অপরদিকে যিনি এফডিআর জমা দিলেন, তাঁর উল্টো আয় হয়। এখানেই ছোট ব্যবসায়ী পিছিয়ে পড়েন।
আর এই যে এফডিআর জমা দিয়ে ঋণপত্র খুললেন, তাঁর আমদানি পণ্যে খরচও কম হচ্ছে। ফলে গুদামজাত করে রাখলে যদি কিছু পণ্য নষ্টও হয়, তাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়।
মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধি কি শিল্প বিনিয়োগ: সাম্প্রতিক কয়েক বছরে শিল্পের মেয়াদি ঋণ বেড়েছে। দেশে গ্যাস-বিদ্যুৎ অবকাঠামোর অপ্রতুলতার কারণে নতুন বিনিয়োগ একেবারেই কমে গেছে এমন অভিযোগ ব্যবসায়ী নেতারা প্রায়ই করেন। তার পরও মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি প্রশ্নবোধক ছিল। আর অনুসন্ধানে যে এলটিআর বা বাজারজাতে স্বল্প সময়ের ঋণ মেয়াদি ঋণে পরিণত হওয়ার তথ্য-উপাত্ত মিলেছে, তাতে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে বিনিয়োগ বাড়েনি। মেয়াদি ঋণ বেড়েছে আমদানি ঋণ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর হয়ে।
আবার অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী আমদানিতে লোকসান দেওয়ায় ব্যাংকের সব টাকা ফেরত দিতে পারবেন না বলে একেবারেই কোনো টাকা ব্যাংকে ফেরত দেননি। তাঁরা এ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন। এ জমিতে শিল্প গড়তে নতুনভাবে ঋণ নেওয়ারও চেষ্টা চলছে।
রমজান মাসে সংকটের আশঙ্কা: তারল্যসংকট থাকায় নতুন ঋণপত্র খোলা কমে গেছে এমন তথ্য দেন ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও এর প্রমাণ রয়েছে। এ কারণে আগামী রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ও এ জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী নুরুল আলম বলেন, দুই কারণেই এলসি খোলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে ব্যাংকের টাকা নেই। আর দ্বিতীয়টি হলো ব্যবসায়ী লোকসান দিয়েছেন, তাই আগ্রহও নেই। তিনি বলেন, ‘এই অবস্থা থাকলে আগামী সময়ে এমন হবে যে টাকা থাকবে, কিন্তু বাজারে মাল থাকবে না।’ নুরুল আলম এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ দেন।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আগের বছরের তুলনায় ভোগ্যপণ্য আমদানি ঋণপত্র খোলা ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ কমে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.