শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-মামা-ভাগনে যেখানে অভাব জয় সেখানে by রহিদুল মিয়া

ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামের একসময়ের নিতান্ত দরিদ্র মানুষদের নিজের চেষ্টায় দিনবদলের গল্প শুনে এই কবিতার কথাই মনে পড়ে। বড় কোনো কিছু করতে না পারলেও অভাব দূর করে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছে তারা।


শুরুর কথা: উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দামোদরপুর। লোকসংখ্যা হাজার দেড়েক। ১৩ বছর আগে এই গ্রামের প্রায় সবাই ছিল অভাবী। গ্রামের বাইরে গিয়ে কাজ পেলে খাবার জুটত, নইলে অনাহার। খাবার জোটাতে তখন কেউ কেউ ভিক্ষাও করত।
১৯৯৮ সালে ওই গ্রামের মরিয়ম বেগমের স্বামী আফজাল হোসেন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ছোট দুই মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে মরিয়ম ভিক্ষায় নেমে পড়েন। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তিন দিনের টানা ঝড়বৃষ্টির কারণে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি মরিয়ম। খাবার জোটাতে না পেরে দুই সন্তানকে নিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে বসে কাঁদছিলেন। ওই বাড়ির পাশ দিয়ে স্থানীয় বাজারে যাচ্ছিলেন গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের দুই তরুণ ইয়াকুব আলী ও আবদুল আজিজ। মরিয়মের কান্না শুনে তাঁরা ওই বাড়িতে ঢোকেন। সব শুনে মরিয়মকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান ইয়াকুব। খাবার তুলে দেন তাঁর হাতে।
মরিয়মের এ কষ্ট গভীরভাবে নাড়া দেয় ইয়াকুব ও আজিজকে। সম্পর্কে তাঁরা মামা-ভাগনে। মরিয়মের জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবেন তাঁরা। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) একজন মাঠকর্মীর সঙ্গে। সেই মাঠকর্মীর পরামর্শে গ্রামের ভিক্ষুক ও দিনমজুরদের সংগঠিত করে চাল সংগ্রহের মাধ্যমে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইয়াকুব ও আজিজের ডাকে সাড়া দেন অনেকে। শুরু হয় তাঁদের দিনবদলের গল্প।
সাফল্যের পথে: ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ছোট আকারের ১১০টি মাটির হাঁড়ি কিনে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর হাতে দেন ইয়াকুব ও আজিজ। প্রতিবেলা রান্না করার জন্য নেওয়া চাল থেকে ওই পাতিলে এক মুষ্টি করে চাল তুলে রাখতে বলা হয়। ১৫ দিন পর পর প্রতিটি পাতিলের চাল সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। এভাবে এক বছরে সংগ্রহ করা চাল বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। সবার মতামত নিয়ে ওই টাকা পাঁচজন ভিখারি ও পাঁচজন দিনমজুরকে চার হাজার টাকা করে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। এ টাকা দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা শুরু করেন।
এগিয়ে চলা: এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হন সবাই। এরপর সবাই মিলে সমিতি গঠনের কাজ শুরু করেন। ২০০০ সালের ২৮ নভেম্বর গঠন করা হয় ‘প্রতিদান সমবায় সমিতি’। চালের পরিবর্তে সমিতির তহবিলে সপ্তাহে ২০ টাকা করে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ‘সপ্তাহে ২০ টাকা জমা দেওয়া অনেকের জন্যই বেশ কষ্ট ছিল। কেউ এক সপ্তাহ দিতে না পারলে পরের সপ্তাহে দিয়ে দিত।’ বলেন ইয়াকুব। এভাবে এক বছরে সমিতির তহবিলে এক লাখ ১৮ হাজার টাকা জমা হয়। এ টাকা দিয়ে কয়েকটি পুকুর ও কিছু জমি ইজারা নিয়ে মাছ-সবজি চাষ শুরু করেন তাঁরা। তিন বছরে সমিতির সঞ্চয় আর বিনিয়োগ করে পাওয়া লাভে তহবিলে জমা হয় নয় লাখ টাকা। তিন লাখ টাকা সমিতির তহবিলে রেখে ছয় লাখ টাকা সদস্যরা ভাগ করে নেন।
ওই টাকা দিয়েও সদস্যরা কেউ শুরু করেন গরু মোটাতাজাকরণের কাজ, কেউ চাল-সবজির ব্যবসা। কেউ কেনেন রিকশা-ভ্যান। ধীরে ধীরে অভাব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হতে থাকেন সবাই। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা আড়াই শ। সপ্তাহে তাঁরা ৪০ টাকা করে সঞ্চয় জমা দেন। দুই বছর পর পর জমানো এ সঞ্চয়ের টাকা তাঁরা ভাগ করে নেন। ১৫ লাখ টাকা স্থায়ীভাবে সমিতির তহবিলে রাখা হয়েছে। সদস্যদের বিভিন্ন প্রয়োজনে এ টাকা থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়।
আরও কিছু: শুধু অভাব দূর করা নয়, ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সমিতির পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে চালু করা হয় একটি শিক্ষাকেন্দ্র। গ্রামের শিশুরা এই কেন্দ্রে লেখাপড়া শিখে পরে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
স্থানীয় উপজেলা কৃষি ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা মাসে এক দিন সমিতির কার্যালয়ে এসে গ্রামবাসীদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, গাভি-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। সমিতির সদস্য আবু বকর জানালেন, শিক্ষক, ইমাম, জনপ্রতিনিধি ও সমিতির সদস্যদের নিয়ে একটি সামাজিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি প্রতিমাসে সভা করে বাল্যবিবাহ বন্ধ, স্বাস্থ্য সচেতনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন করে।
‘শুরুতে চাল সংগ্রহের মতো ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়ে শুরু করে আমরা আজ এই পর্যায়ে এসেছি। সমিতির নামে এখন ব্যাংকে ১৫ লাখ টাকা আছে। সমিতির টাকায় দুই কিলোমিটার সড়কে প্রায় নয় হাজার গাছের চারা লাগানো হয়েছে।’ জানালেন সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্য রবিউল ইসলাম।
সবজি ও মাছ চাষ সমিতির আয়ের মূল উৎস। এ আয় থেকে অন্য গ্রামের অভাবী ছেলেমেয়ের বিয়েতে সহায়তা করা হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কিনে দেওয়া হয় বই-খাতা। ঈদ ও পূজায় আশপাশের গ্রামের অভাবী মানুষকে কাপড়, সেমাই, চিনি বিতরণ করা হয়।
সফল অনেকেই: বছর সাতেক আগে স্বপ্না বেগম সমিতি থেকে সাত হাজার টাকা ঋণ নেন। পাঁচ হাজার টাকায় একটি সেলাই মেশিন কেনেন। সবজির ব্যবসার জন্য স্বামীকে দেন দুই হাজার টাকা। স্বামীর সবজির ব্যবসা আর নিজের সেলাইয়ের কাজে তাঁদের মাসিক আয় এখন প্রায় নয় হাজার টাকা।
গৃহবধূ শেফালী বেগম বলেন, ‘সমিতি খালি হামার আয় উন্নতি বাড়ায় নাই, নেকাপড়াও শিখাইছে।’ রিকশাচালক আবুল কালাম বলেন, ‘এলা মুই বই পরবার পাঁরো, হিসাব জানো, নাম ও নেকপার পাঁও, অ্যালা মোক কেউ ঠগপ্যার পারবে না।’
অন্যদের কথা: দামোদরপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম বলেন, সমিতির কাজকর্ম খুবই ভালো। এই সমিতি অসহায় মানুষের বিপদে সহায়তা দেওয়াসহ নানা কাজ করে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রোকনুল ইসলাম বলেন, এই সমিতির কার্যক্রম আর দশটি সমিতির চেয়ে একেবারেই আলাদা। এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত।
কী বলেন ইয়াকুব-আজিজ: সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ইয়াকুব (৩৬) ও আজিজ (৩৭)। তাঁরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। মাসে এক দিন বাড়ি এসে সমিতির বিষয় নিয়ে সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ‘অভাব দূর করতে অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বুদ্ধির। আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অভাব দূর করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামের মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি’, বলেন তাঁরা।
স্বীকৃতি: সমিতির এই কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে। ২০০৪ সালে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ সমিতিকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.