সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা-‘পিরোজপুরে ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়’

পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে পিরোজপুরে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ওই সময় কয়েক শ নারী ধর্ষণের শিকার হন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন গতকাল বুধবার জবানবন্দিতে এ কথা বলেন।


এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২৮তম সাক্ষী হেলালউদ্দিন গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ টানা সপ্তম দিনের জবানবন্দি দেন। সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হলে তিনি আবার জবানবন্দি শুরু করেন। সাঈদী এ সময় আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
হেলালউদ্দিন জবানবন্দিতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পিরোজপুরের বিভিন্ন নদীতে শত শত মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের সহযোগী বাহিনী এসব মানুষকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। তিনি বলেন, দাখিল পরীক্ষার সনদপত্র অনুসারে, সাঈদী ১৯৪০ সালে পিরোজপুরের সাউথখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ছারছিনা দারুস সুন্নত আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিছুদিনের মধ্যে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ আসে, সাঈদী জামায়াতের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। পরে তিনি ১৯৬০ সালে বারইপাড়া ছিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তাঁর নামের আগে ‘আল্লামা’ বা ‘মাওলানা’ লেখার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তৎকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম, মন্ত্রী এ কে এম ইউসুফ, পিরোজপুর শান্তি কমিটির সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ মো. আফজালের (মৃত) পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুসারে জামায়াতের নেতা সেকান্দার শিকদার (মৃত), দানেশ মোল্লা (মৃত), সাঈদীসহ আরও অনেককে নিয়ে পিরোজপুরের পাড়েরহাটে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা পরে সাঈদী ও বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র, স্থানীয় জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে পাড়েরহাটে মে মাসের শুরুতে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী গঠন করে। রাজাকাররা পাড়েরহাট বন্দরে ফকিরদাসের দালান দখল করে ক্যাম্প করে। এ সময় তিনি ট্রাইব্যুনালের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে সেই দালানের ছবি দেখান। তিনি বলেন, একাত্তরের ৩ মে কর্নেল আতিক, মেজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন এজাজ ও অন্য সেনারা পিরোজপুরের দায়িত্ব নেন। তাঁরা পিরোজপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ক্যাম্প করেন। পাকিস্তানি সেনারা পিরোজপুরে যাওয়ার পর শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সভা করে। সাঈদী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন এবং পরে জামায়াতের নেতাদের পরিকল্পনা অনুসারে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ও সশস্ত্র রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ উল্লেখিত ৩(২) ও ৪(১) ধারায় বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন।
জবানবন্দির এই পর্যায়ে হেলালউদ্দিন তদন্তে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাঈদীর বিভিন্ন অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। এর মধ্যে রয়েছে: ৪ মে পিরোজপুরের মধ্য মাছিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে ২০ জনকে গুলি করে হত্যা, একই দিনে মাছিমপুরের হিন্দুপাড়ায় লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৩ জনকে গুলি করে গণহত্যা সংঘটন, একই দিনে সদর থানার এলজিইডি ভবনের পেছনে হিন্দু সম্প্রদায়ের চারজনকে হত্যা প্রভৃতি। হেলালউদ্দিন এসব ঘটনাস্থলের স্থিরচিত্র ও কয়েকটি ক্ষেত্রে ভিডিওচিত্র দেখান। চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পসারির বাড়িতে লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগ, ইবরাহিম কুট্টিকে অপহরণ ও গুলি করে হত্যার ঘটনা বলার সময় তিনি বেসরকারি টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের ‘একুশের চোখ’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালকে দেখান।
হেলালউদ্দিন বলেন, পিরোজপুরের ইন্দুরকানি (জিয়ানগর) থানা ও এর আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক-দেড় শ লোককে জোর করে মসুলমান করার অপরাধের সঙ্গে সাঈদী জড়িত। এমন তিন ব্যক্তি গৌরাঙ্গ সাহা, মধুসূদন ঘরামি ও অজিত কুমার শীলের ছবি ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়ে তিনি বলেন, এই তিনজনই এই মামলার সাক্ষী। তিনি আরেক সাক্ষী অসুস্থ উষা রাণী মালাকারের ছবিও ট্রাইব্যুনালকে দেখান।
বিকেল চারটার দিকে হেলালউদ্দিনের জবানবন্দি অসমাপ্ত অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারান। সম্ভ্রম হারান দুই লাখ নারী। ওই সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.