আবুল খায়ের দুর্যোগে দুঃসাহসী

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক নুরুল হক বললেন, ‘আবুল খায়ের, তুমি কি যেতে পারবে?’আবুল খায়ের বললেন, ‘পারব স্যার। কিন্তু ফিরে আসতে পারব, সে আশা নাই। আমি মারা গেলে স্যার লাশটা বাড়িতে পাঠায় দিয়েন!’


ঘটনাস্থল আরিচাঘাটের কাছাকাছি। সময়টা ২০০৫ সালের মে মাস। দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে লঞ্চ এম ভি রায়পুরা। নদী তখন উত্তাল, স্রোতের বেগ প্রায় ১৭ নটিক্যাল মাইল। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর চার দিন পেরিয়ে গেছে, তখনো লঞ্চের ধারেকাছে যাওয়া যাচ্ছে না। নৌবাহিনী, বিআইডব্লিউটিএ—সবার চেষ্টা বৃথা। যমুনাপারের বাতাস তখন স্বজনহারাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে।
ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি আবুল খায়ের। প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতে খায়ের প্রাণপণ সাঁতরে চলেন। একসময় তাঁর হাত-পা অসার হয়ে আসে। ইতিমধ্যে ১৩ বার থেমে থেমে বিশ্রাম নিয়েছেন, এবার আর বিশ্রামে শরীর মানে না। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কৃপণ সরবরাহে তখন ফুসফুসটা শান্ত হচ্ছে না, চাই মুক্ত বাতাস। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অন্ধের মতো হাত বাড়ান খায়ের, কি যেন হাতে ঠেকে। ভালোমতো পরখ করে বুঝতে পারেন, লঞ্চের রেলিং! দুঃসাহসী ডুবুরিকে কাবু করতে স্রোতও তখন উঠেপড়ে লেগেছে। যেন শরীর ছিঁড়েবিড়ে নিয়ে যাবে! রেলিং দুই পায়ে জড়িয়ে ধরে, বয়ে নিয়ে আসা নোঙরের দড়িটা লঞ্চের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধেন খায়ের। লম্বা একটা দম নিয়ে, ঢুকে পড়েন লঞ্চের ভেতর।
টর্চের আবছা আলোয় দেখতে পান, শতাধিক ফুলে-ফেঁপে ওঠা লাশ!
খায়েরের তখন সময় খুব কম। সিলিন্ডারের অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে হিসাব করে। হিসাবে গরমিল হলেই লঞ্চের ভেতর লাশের সংখ্যা বাড়বে আরও একটা! কিন্তু এত দূর এসে খালি হাতে ফিরে যাবেন? মৃত দেহগুলোর তখন গায়ে হাত দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বহু কষ্টে একটা লাশ সঙ্গে নিয়ে লঞ্চের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন খায়ের। সঙ্গে সঙ্গে লাশটা প্রচণ্ড বেগে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। খায়ের তখনো লাশটাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। এরপর তাঁর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরলে খায়ের নিজেকে আবিষ্কার করেন উদ্ধারকর্মীদের জাহাজে।

ফায়ার সার্ভিসের দুর্ধর্ষ ডুবুরি আবুল খায়ের, বহুবার নিজের জীবন বিপন্ন করে অংশ নিয়েছেন উদ্ধারকাজে। জলে কিংবা স্থলে, যেকোনো জটিল উদ্ধারকাজে ডাক পড়ে তাঁর। আবুল খায়েরও ছুটে যান নিঃসংকোচে। ইতিমধ্যেই দুঃসাহসী কাজের জন্য বেশ কিছু স্বীকৃতি মিলেছে তাঁর, দেশে-বিদেশে বহু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর জীবনের সত্যিকারের গল্প। পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, জাতিসংঘের কাছ থেকেও মিলেছে স্বীকৃতি। আবুল খায়ের বললেন, ‘৭০টা দেশে ২১টা ভাষায় আমার জীবনকাহিনি ছাপা হইছে। এই খবর আমি পত্রিকায় পইড়া জানছি।’
গত ২২ বছরে অসংখ্য উদ্ধারকাজে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া ডুবুরি আবুল খায়ের এখন ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের গর্ব। অথৈ জলের অতলে ঘুরে বেড়ানোটা যাঁর কাছে ছেলেখেলা, কোথায় তাঁর সাঁতারের হাতেখড়ি—জানতে চাই। আবুল খায়েরের গল্প শুনতে শুনতে কল্পনার চোখে আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা, শেরেবাংলা হাইস্কুলের সঙ্গেই একটা টলটলে পানির দিঘি!


আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। ১১-১২ বছরের ছোট্ট ছেলে খায়ের। গ্রামের শেরেবাংলা হাইস্কুলসংলগ্ন যে দিঘি, দিনভর দাপিয়ে বেড়ান সেখানে। সঙ্গীরা বলে, ‘দূর, তোর লগে সাঁতরায় পারা যায় না।’ একবার আশপাশের ১২টা হাইস্কুলের মধ্যে সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে । শেরেবাংলা হাইস্কুল থেকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গেলেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র খায়ের। কল্যাণসাগর দিঘিতে সাজ সাজ রবে অনুষ্ঠিত হলো প্রতিযোগিতা, আবুল খায়ের প্রথম হলেন। পুরস্কার হিসেবে পেলেন চারটি থালা, একটি তরকারির বাটি, লবণদানি, আর কলম।
নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে বিদ্যালয়ের পাট চুকল। চাচার সঙ্গে ঢাকায় এলেন খায়ের। একদিন চোখে পড়ল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। খায়ের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিলেন। কল্যাণসাগর দিঘির প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া সেদিনের সেই আবুল খায়ের, এখানেও হলেন প্রথম!
দিনটা ছিল ১৯৯০ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখ। আবুল খায়ের যোগ দিলেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টে।
এরপর কেটে গেছে প্রায় ২২ বছর। এত বছরে কত অজস্র উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন, সবগুলো মনেও করতে পারেন না আবুল খায়ের। আবছা আবছাভাবে বললেন নারায়ণগঞ্জের মুন্সিখোলায় লঞ্চডুবি, বুড়িগঙ্গায় টহল পুলিশের নৌকাডুবি, আমিনবাজারের বাস দুর্ঘটনা, চট্টগ্রামে দুর্ঘটনাকবলিত প্রশিক্ষণ বিমান, মিরপুরে গার্মেন্টস আর কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের অগ্নিকাণ্ড, মহাখালী ফিনিক্স ভবন ধসে পড়াসহ বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা। সম্প্রতি মেঘনায় ঘটে যাওয়া লঞ্চডুবির উদ্ধারকাজেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন আবুল খায়ের। বললেন, ‘নিহত মানুষের আত্মীয়স্বজনের কান্না দেখতে খুব খারাপ লাগে। শেষ সান্ত্বনা হিসেবে লাশটা তাদের হাতে পৌঁছায় দিতে পারলে কিছুটা শান্তি পাই।’
এত বছরের চাকরিজীবনে অসংখ্য লাশ দেখেছেন তিনি। এমন কোনো মৃত ব্যক্তির মুখ আছে, যা এখনো মনে পড়ে? ‘আমিনবাজারে বাস নদীতে পইড়া গেছিল। সেইখানে উদ্ধার করছিলাম একটা দু-তিন বছরের বাচ্চা, কী সুন্দর দেখতে! আমার চোখে পানি আইসা পড়ছিল। বাচ্চাটারে পাইছিলাম বাসের বাইরে, আর বাচ্চার মায়েরে পাইছিলাম বাসের ভিতর। আমার ধারণা, বাসটা পড়ার সময় মা শেষ চেষ্টা হিসাবে বাচ্চাটারে বাইরে ফালায় দিছিল, বাঁচাইতে পারে নাই!’— বলতে বলতে ওপর দিয়ে দেখতে প্রচণ্ড শক্তপোক্ত মানুষটার ভেতরের নরম মনটা প্রকাশ পেয়ে যায়। এ ছাড়া আবুল খায়ের এএফপির সাংবাদিকের কাছে বলেছিলেন আরও একটি অভিজ্ঞতার কথা, ‘ডুবে যাওয়া একটা ফেরি থেকে বর-কনের বিয়ের সাজে সজ্জিত লাশ ছিল আমার জীবনে বয়ে নেয়া সবচেয়ে ভারী লাশ!’


দেশের বাইরে বাংলাদেশের এই ডুবুরিকে নিয়ে প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে দুবাইয়ের খালিজ টাইমস। এরপর রিডার্স ডাইজেস্ট, ব্যাংকক পোস্টসহ বেশ কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আবুল খায়েরের দুঃসাহসিকতার গল্প। ব্যাংকক পোস্ট-এ আবুল খায়েরকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের নাম ছিল, ‘আ ট্রু সুপারস্টার’! বিএসইসি ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে পা ভেঙেছিলেন আবুল খায়ের। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। খায়ের বলেন, ‘নৌবাহিনীর লে. কর্নেল মাহাবুব, বিদেশ থেকে ট্রেনিং কইরা আসছেন। তিনিও আমার খুব সুনাম করেন। ফায়ার সার্ভিসের কারও সাথে দেখা হইলে রসিকতা কইরা বলেন, “খায়ের কি এখনো বেঁচে আছে?” আমার সহকর্মীরাও বলে, আমি যেরকম ঝুঁকি নিয়া কাজ করি, আমার অনেক আগেই মইরা যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার উপর আল্লাহর রহমত আছে, তাই এখনো বাঁইচা আছি।’
খায়ের বললেন, ব্যক্তিগত অর্জনের কথা তিনি ভাবেন না। ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের মুখ উজ্জ্বল করাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়। ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড যখন নিতে গেছিলাম, ফায়ার সার্ভিসের ডিজি স্যার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমারে পরিচয় করায় দিতে গিয়া বলেছিলেন, “ম্যাডাম, এই আমার খায়ের!”’ বলতে বলতে খায়েরের মুখে ফুটে ওঠে সন্তুষ্টির হাসি।
খায়েরের কাছে জানা হলো, একবার দক্ষিণ কোরিয়া ডুবুরিদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। ভারত, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের সেরা ডুবুরিরা অংশ নিয়েছিলেন সেই প্রতিযোগিতায়। সেখানেও প্রথম আমাদের খায়ের! বললেন, ‘এখনো মহড়ার সময় আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি কেউ কাজ করতে পারে না। চারতলা মই বাইয়া ৭০-৮০ কেজি মানুষেরে সবার আগে আমি নামায় নিয়া আসি।’
শুকনা লিকলিকে শরীর, কথার মাঝখানে বারবারই খকখক করে কাশছেন। বয়সও তো কম হয়নি। নাহ, সন্দেহটা লুকিয়ে রাখা গেল না, প্রশ্ন করে বসলাম, ‘সত্যিই পারেন’? খায়ের যেন রীতিমতো খেপে উঠলেন, ‘আপনার মতো চাইর জনরে পাঁচতলার উপর থেইকা মই বাইয়া নামায় আনতে পারুম এখনো, সবার আগে। আমারে দেখলে মনে হয় গায়ে জোর নাই, কিন্তু আমার মনের জোর খুব’!


ব্যক্তিজীবনে আবুল খায়েরের যমজ ছেলেমেয়ে। ইসমাত আরা, আর জিহাদুল ইসলাম। মেয়েটা ইংরেজিতে অনার্স পড়ছে, ছেলেটা লেগুনা চালায়। আর আপনার স্ত্রী?
চোখ বড় বড় করে এতক্ষণ নিজের দুঃসাহসিকতার গল্প বলে যাওয়া আবুল খায়েরের চোখ দুটো এই প্রথম কিছুটা নিষ্প্রভ দেখায়। জানা হলো, আবুল খায়েরের স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত। খায়ের বললেন, ‘মেঘনায় যেদিন লঞ্চ ডুবল, তার দুই দিন আগেই আমার স্ত্রীর অপারেশন হইছে। তবু, আমি কাজে গেছি। খুব দুশ্চিন্তা নিয়া কাজ করছি। মেয়েটা তিন মাস ধইরা কলেজে যাইতে পারতেছে না, ছেলেটা দিনরাত কষ্ট করে। বলে, “আব্বু, আম্মুর চিকিৎসার জন্য তো অনেক টাকা দরকার!”’ নাম কি আপনার স্ত্রীর?—জানতে চাই। আবুল খায়ের বলেন, ‘নুরজাহান’। বলি, ‘বাহ্, বিখ্যাত নাম।’ শুনে এবার খায়েরের মুখে লাজুক হাসি, ‘জি ভাই। নুর মানে আলো, আর জাহান মানে পৃথিবী। পৃথিবীর আলো।’
প্রায় ২৫ বছর আগে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন খায়ের। প্রিয়তমা স্ত্রী নুরজাহানকে ‘পৃথিবীর আলো’ দেখাতে চান আরও অনেক দিন। দুঃসাহসী এই যোদ্ধা জীবনযুদ্ধে এত সহজে হার মানার লোক নন, বোঝা যায় তার কথায়, ‘ভাই, যত টাকাই লাগুক, আমি আমার স্ত্রীরে ভালো কইরা তুলমু।’

No comments

Powered by Blogger.