ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের জনগণের ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কার্য প্রতিরোধে দীর্ঘ ১৭ বছরের প্রচেষ্টার ফসল ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। আমাদের দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধি, খাবার ও ওষুধে ভেজাল, ওজনে কম, প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন,

সরকারি ও বেসরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে বিড়ম্বনা ইত্যাদি ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ এখন আর কোনো বিশেষ সংবাদ নয়, যেন স্বতঃসিদ্ধ এক একটি নিত্য সত্য। এ অবস্থায় সরকার ২০০৯ সালে এই আইনটি প্রণয়ন করে। যদিও আইনটিতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে তথাপি বহুল প্রতীক্ষিত এই আইনটি জনগণের মনে আশার সঞ্চার করে। বিশ্বে ভোক্তা-অধিকারের ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে সচেতন নাগরিকরা সমাজে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে আসছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে। বাংলাদেশের ভোক্তাদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে ১৯৯২ সাল থেকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), বাস্ট, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও, বিভিন্ন পেশাজীবী, গোষ্ঠী ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং আইন প্রণয়ন করে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে ১৯৯৮ সালে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়। খসড়া আইনটি তৎকালীন কেবিনেটে প্রাথমিক অনুমোদন পেলেও অজানা কারণে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত খসড়া আইনটি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। বিগত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার এটিকে সামনে নিয়ে আসে এবং এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান সংসদ কর্তৃক আইনটিকে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ নামকরণ করে পাস করে। ভোক্তা অধিকার আইনে ৭টি অধ্যায়ে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে শিরোনাম, প্রবর্তন ও সংজ্ঞা। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ ধারায় 'জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ' নামে ২৪ সদস্যের একটি পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে যার চেয়ারম্যান হবেন বাণিজ্যমন্ত্রী। পরিষদের উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য মহাপরিচালককে নির্দেশ প্রদান, প্রবিধিমালা প্রণয়ন, ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা, সরকারকে পরামর্শ প্রদান, গবেষণার ব্যবস্থা করা, মহাপরিচালক এবং অধিদপ্তরে কাজকর্ম তদারকি ও পর্যবেক্ষণ করা, জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করা ইত্যাদি। এই অধ্যাদেশের অধীনে প্রতি জেলায় জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে একটি জেলা ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ কমিটি থাকবে। এই কমিটি ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কে পরিষদের নির্দেশনা প্রতিপালন করবে এবং পরিষদকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যাবলি তদারক ও পরিবীক্ষণ করা, জনসচেতনতার জন্য বিভিন্ন প্রচারণা, সভা ও কর্মশালার আয়োজন করা ইত্যাদি কমিটির অন্যতম কাজ হবে (ধারা ১০-১১)। তৃতীয় অধ্যায়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠনের কথা বলা হয়েছে যার প্রধান হবেন সরকার কর্তৃক নিযুক্ত মহাপরিচালক। প্রধান কার্যালয় থাকবে ঢাকায় এবং প্রয়োজন মনে করলে সরকার ঢাকার বাইরেও এর শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে। মহাপরিচালকের কাজ হবে ভোক্তাসাধারণের অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকারবিরোধী কাজ প্রতিরোধ করা এবং ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি করা। এরূপ কার্যাবলি পরিচালনার জন্য মহাপরিচালকের বিভিন্ন রকম কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ভোক্তা-অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন কাজ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা এবং নকল পণ্য বাজারজাত, অবৈধ মজুদ, ভেজাল, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন, লাইসেন্স ব্যতিরেকে পণ্য বা ওষুধ উৎপাদন, অসত্য বিজ্ঞাপন প্রচার, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন, আইন লঙ্ঘন করে সেবা গ্রহীতার জীবন বিপন্ন হচ্ছে কি না ইত্যাদির তদারকি করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অন্যতম। ভেজাল পণ্যের আটক ও নিষ্পত্তি করাও মহাপরিচালকের অন্যতম কাজ হবে (ধারা ১৮-৩৬)। চতুর্থ অধ্যায়ে ভোক্তা-অধিকারবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অপরাধ ভেদে বিভিন্ন মেয়াদের করাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এখানে কারাদণ্ডের পরিমাণ অনূর্ধ্ব তিন বছর এবং অর্থদণ্ড অনধিক দুই লাখ টাকার বিধান রাখা হয়েছে (ধারা ৩৭-৫৬)। পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন অপরাধগুলো জামিনযোগ্য, আমলযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে এবং প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার্য হবে। মামলার কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে এবং অভিযোগ দায়েরের ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করা না হলে ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করবেন না। ম্যাজিস্ট্রেটের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে সেশন জজের আদালতে আপিল করা যাবে (ধারা ৫৭-৬৪)। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ভোক্তা ফৌজদারি মামলা দায়ের ছাড়াও ক্ষতির পরিমাণ আর্থিক মূল্যে নিরূপণযোগ্য হলে ক্ষতির অনধিক পাঁচগুণ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দেওয়ানি প্রকৃতির বা ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করতে পারবেন। যুগ্ম জেলা জজের রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা যাবে। আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের প্রতিস্থাপনের নির্দেশ এবং ত্রুটিপূর্ণ পণ্য ফেরত নিয়ে পণ্যের মূল্য বাদীকে ফেরত প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন (ধারা ৬৬-৬৮)। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তদনুযায়ী ২০১২ সালের ১৫ মার্চ পৃথিবীর দেশে দেশে ভোক্তা-অধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। বিগত ২৭ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লক্ষণীয়ভাবে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণে আইন প্রণয়নসহ এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমে সফল হয়েছে। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে এক ডজনেরও বেশি আইন ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো কিন্তু এগুলোর সঠিক প্রয়োগ হতো না। বহুল প্রতীক্ষিত এই ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ এখনো এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা ভোক্তাবান্ধব বা গণমুখী নয়। বিবর্তনশীল সমাজের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে যুগোপযোগীভাবে গঠন করা প্রয়োজন। একজন ভোক্তা যাতে ন্যায়বিচার পান সে জন্য অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি ও তা নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়া আরো সহজীকরণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পরিষদ, অধিদপ্তর ও জেলা কমিটিকে হতে হবে সেবাধর্মী, জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক এবং সব ক্ষেত্রে অবৈধ প্রভাবমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত। এ জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সরকার, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জেলা প্রশাসনের সদিচ্ছা ও সমন্বয় আবশ্যক।
লেখক : সাবেক সভাপতি, সিলেট আইনজীবী সমিতি

No comments

Powered by Blogger.