যুক্তি তর্ক গল্প-নিষ্ক্রিয় বিবেক জাগলেও বিশেষ লাভ নেই by আবুল মোমেন

গত কয়েক দিনে দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে পুরো জাতি বেদনাহত, স্তম্ভিত। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮ স্কুলছাত্রের (মোট ৪০ জন) মর্মান্তিক মৃত্যু এবং ঢাকার সাভারের কাছে ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসীর পিটুনিতে ছয় ছাত্রের ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড এমন দুটি ঘটনা। এর কিছু আগে পাষণ্ড স্বামীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দুটি চোখই

নষ্ট হয়ে দৃষ্টিশক্তি খোয়ানোর ঘটনাটিও পুরো জাতিকে বিচলিত করেছে। ডাকাতদের গুলিতে শিশু নূহার মৃত্যু কিংবা রাজধানীর বিখ্যাত স্কুলে শিক্ষকের দ্বারা স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের শিকার হওয়া অথবা এক বাংলাদেশি যুবক কর্তৃক এক বিদেশি (জাপানের) খ্যাতিমান পণ্ডিত ও রবীন্দ্রগবেষকের প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনাও দেশের সচেতন নাগরিকদের পীড়িত, লজ্জিত ও শিহরিত করেছে। দেশে এ রকম নেতিবাচক লোমহর্ষক ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে। দৈনিক পত্রিকার পাতা খুঁটিয়ে পড়লে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, প্রতারণা, দুর্নীতির সীমাহীন পুনরাবৃত্তির কথাই আমরা জানতে পারব। তাতে সংবেদনশীল মানুষমাত্রই হতাশা, লজ্জা, রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি বিচিত্র অনুভূতিতে আক্রান্ত হবেন।
এতসব নেতিবাচক ঘটনার মধ্যে যে একটি আশার আলো দেখা যায়, তা হলো মানুষের এই অনুভূতি। অধিকাংশ মানুষ এসব বর্বর নেতিবাচক খবর পড়ে দুঃখ-কষ্ট-হতাশায় কাতর হন, কিছু একটা করতে চান। তা থেকে বলা যায়, দেশের মানুষের বিবেক এখনো জাগ্রত আছে, অন্তত তেমন ঘটনায় ঠিকই জেগে ওঠে এবং কষ্ট পায়, কিছু করার তাগিদ বোধ করে। এই হতাশার মধ্যে এও কম কী! আবার তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিবেক জেগে ওঠে বা কষ্ট পায় ঠিকই, কিন্তু ঠিক সক্রিয় হয় না, পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ ভূমিকা নেওয়ার জন্য বিবেকবান ব্যক্তিটিকে তাগাদা-তাড়া দিতে পারে না। বলা যায়, এই হলো নিষ্ক্রিয় বা প্যাসিভ বিবেক, সক্রিয় নয়। বোঝা যায়, ব্যক্তি এখানে আপন সাংসারিক গণ্ডিতে আবদ্ধ মানুষ, যিনি নিজের ও পরিবারের দায় পালনের বাইরে সমাজ, জাতি বা ইতিহাসের দায় গ্রহণে প্রস্তুত নন। অথচ স্বাধীনতার আগে এ-ই ছিল আমাদের শক্তি। তখনকার রাজনীতি ও নেতৃত্ব দেশের আপামর মানুষকে মহ ৎ আদর্শে ও বৃহত্তর লক্ষ্যে ধীরে ধীরে এক করতে পেরেছিল। তাই তো বহু মানুষের অংশগ্রহণে, ত্যাগে-বীরত্বে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। এভাবে মানুষকে রূপান্তর ও প্রস্তুত করার পেছনে হক-ভাসানী-মণি সিংহসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতার অবদান থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল সবার চেয়ে বেশি এবং সবার ওপরে। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু, তাই জাতির পিতা।
কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই মহ ৎ আদর্শ ও বৃহ ৎ লক্ষ্য থেকে চ্যুত হলো জাতি, সেই সঙ্গে গেল তার বীরত্ব, ত্যাগ ও ঐক্য। মানুষ আপন স্বার্থের গণ্ডিতে বাঁধা পড়তে থাকল। ছাত্র ও নিম্নবর্গের মানুষের সাহস, সংগ্রাম ও ঐক্যে তার পরও নব্বই পর্যন্ত কিছু কিছু অর্জন সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত জনগণের সব স্তরেই যেন স্বার্থের এই প্রলোভন ও হিংসা-হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ল। এ অবস্থায় বিবেক রইল বটে, কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য জেগে ওঠা ছাড়া তার আর কিছুই করার ইচ্ছা, প্রণোদনা ও কর্মশক্তি রইল না। ফলে এক অভিশপ্ত জাতির মতো আমরা মানুষ হিসেবে নষ্ট হতে থাকলাম, আর জাতি হিসেবে কেবল তলিয়ে যাচ্ছি।
অনেক কাল আগে মার্কিন মানবাধিকার নেতা শহীদ মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, মানব জাতির জন্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবে, যখন বুদ্ধিমান মানুষজন অন্যায় ঘটতে দেখবে কিন্তু প্রতিকারের কথা কিছুই বলবে না। আমরা দেখছি, যেসব ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা শুরুতে বলেছি, সেসব জানার পর মানুষ নানা কথা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ক্রোধ, হতাশা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়ারই প্রকাশ ঘটে, তাতে বড়জোর অপরাধীর শাস্তির দাবিটাই ওঠে। কিন্তু অপরাধ ও শাস্তি—এই পদ্ধতিতে সমাজ তার সমস্যা বা ব্যাধি থেকে নিস্তার পায় না। অপরাধের পুনরাবৃত্তির কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের ব্যবস্থা না করে কেবল আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে তো পরিত্রাণ মিলবে না। ফলে বোঝা যায়, আমরা যেকোনো ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি, কিন্তু তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছি না, সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে নিচ্ছি না। ধরা যাক, তরুণদের একটি বড় অংশের নেশায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি, যা থেকে খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অনাচার সমাজে ঘটে চলেছে। অপরাধীদের ধরে ধরে অপরাধ অনুযায়ী জেল, জরিমানা, ফাঁসি দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আমরা খেলার মাঠ দখল করে বাড়ি বা শপিং মল বানাব, স্কুলে স্কুলে পাঠাগার তুলে দেব, পরীক্ষা-মুখস্থের চাপে গান-নাটকের আনন্দ থেকে তাদের বঞ্চিত করব, অতি ব্যস্ত শিক্ষক-অভিভাবকেরা তাদের কোনোরূপ সঙ্গ-সময় দেব না আর তারুণ্যের বিপথগামিতা বন্ধ হয়ে যাবে?
আরও একটি দৃষ্টান্ত দিই। বাঙালি চিরকালই কাব্য ও সুরেলা গানের ভক্ত, কিন্তু আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু যদি বলি, আজ টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিনোদনের মূল মাধ্যম হয়ে ওঠার পরও আমরা কি এমন কোনো নীতিমালা তৈরি করেছি, যাতে সব চ্যানেলে সব বেতারে নির্দিষ্ট এবং যথেষ্ট সময় দিয়ে কবিতা ও ঐতিহ্যবাহী গান পরিবেশনের ব্যবস্থা থাকে? করিনি। এর মধ্যেও কিন্তু একটি জাতির অনাকাঙ্ক্ষিত মানস পরিবর্তনের—কোমল উদার মানবিক থেকে নির্মম অমানবিক স্বার্থান্ধ—ধারা বন্ধ করার উপায় নিহিত আছে।
আমাদের সংকটের দুটি দিক আমি লক্ষ করি। একদিকে যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনাকে সংকীর্ণভাবে অপরাধ রূপেই দেখছি, এর প্রেক্ষাপট ও অন্যান্য মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিকারের কথা ভাবতে পারছি না। আর দ্বিতীয় হলো, বৈষয়িক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে মানবজীবনের যে বৃহত্তর-মহত্তর অর্জন-লক্ষ্য আছে, সেই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে একটা পলায়নি মনোবৃত্তি, নিজের মনকে চোখ ঠারার ও বুঝ দেওয়ার মনোবৃত্তি কিংবা সোজা ভাষায়, এসব ফাঁকি দিয়ে ভোগদখলের দিকে ঝুঁকে পড়েছি।
এর ফল হলো, মানুষ হিসেবে আমাদের ক্ষয় হচ্ছে, পতন ঘটছে। ছোট লক্ষ্য নিয়ে তো ছোটলোকই হওয়া যায়। এ থেকে একটা ভয়ংকর বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশে মেধাবী ছাত্র-তরুণের অভাব নেই, তার প্রকাশ অল্প বয়সে বা বিদেশে তারা ঘটাচ্ছে। কিন্তু এখানে যেহেতু সর্বত্র ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডিতে বাঁধা মানুষই প্রবল, ফলে সব ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গে, তাদের হিসাবমতো চলার চাপটাই প্রধান। দলাদলি, লাগালাগি, হানাহানি, খিস্তিখেউড়, মামলা-মোকদ্দমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে সমাজ। সেই পরিবেশে বড় মানুষ হওয়া, বড় থাকা সম্ভব নয়। তাই হয় দেশ ছাড়ে প্রতিভাবান মানুষ, নয়তো আমাদের দেখতে হয় প্রতিভাবান ও মেধাবীদের দুঃখজনক পরিণতি কিংবা মর্মান্তিক ভোগান্তি।
আমরা জাতি হিসেবে কয়েকটি বিষয় একদমই পারিনি—আমরা পরচর্চা ও পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছ নিস্পৃহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অন্যদের বিচার করতে শিখিনি, আমরা গঠনমূলক সমালোচনার ঐতিহ্য তৈরি করতে পারিনি ও সত্য সমালোচনা গ্রহণ করতে শিখিনি। আমরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নতুন জিনিস গ্রহণ করলেও চিন্তার জগতে পুরোনো ধ্যানধারণা ছাড়তে পারি না বলে সমাজমানসের রূপান্তরে নবায়ন ঘটাতে পারিনি। এসব ব্যর্থতার কারণে কতকগুলো জাতিগত বৈশিষ্ট্য ছাড়তে পারি না—সহজেই দল পাকাই ও দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ি; অর্থা ৎ আমরা কলহপ্রবণ, দুর্নীতি ও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে ফেলি; অর্থা ৎ নতুন চিন্তাভাবনা-বিষয় নিয়ে মুক্তমনে ভাবি না; অর্থা ৎ আমরা অচলায়তন তৈরি করি।
এ রকম মানস ক্ষয়িষ্ণু, সেখানে অপরাধ বাড়বে, অন্যায় প্রশ্রয় পাবে এবং মেধাবী ও অগ্রণী মানুষ ভুল বোঝার ও অন্যায় আচরণের শিকার হবে। প্রায়ই ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, ভালো-মন্দের ভেদরেখা অস্পষ্ট হয়ে পড়বে। অধিকাংশ মানুষ থাকবে বিভ্রান্ত, অস্থির ও হতাশ।
প্রাচীন সমাজে সক্রেটিস, ব্রুনো, জোয়ান অব আর্ক, মনসুর হাল্লাজ, গ্যালিলিও সত্যের বা নিজ মতামতের জন্য প্রাণ দিয়েছেন কিংবা নির্যাতিত হয়েছেন। পশ্চিম সেই অবস্থা রেনেসাঁসের পরে কাটিয়ে উঠেছে। আমরা এখনো ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে শান্তি ও অগ্রগতির পরিবর্তে হানাহানি হতে দেখছি। জমি, টাকা, নারী, ধর্ম—সবই তো আদিম সমাজের মতো অধিকার, দখল, লুণ্ঠনের বিষয় হয়েই রইল।
আধুনিকতা নিয়ে অনেক তর্ক আছে, তা জেনেও বলব, আমাদের পুরোনো জমানা খতম করতে হবে, যেমনটা ফরাসি বিপ্লবের নায়কেরা বলেছিলেন। তার পরই একটি গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। সমাজকে না বদলে তথা সংস্কার না করে কেবল নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার করে বা সরকার পরিবর্তন করে এগোবার কোনো পথ নেই। বিশেষভাবে বলব, বাঙালি মুসলিম সমাজে পরিবর্তন ও প্রগতির জন্য কোনো সংস্কার আন্দোলন হয়নি—সেই ১৯২৬-৩০-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছাড়া। সেই স্বল্পস্থায়ী সীমিত গণ্ডির আন্দোলনই কিন্তু পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলন ও গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রেনেসাঁসের পেছনে মূল ভাব ও চিন্তার প্রেরণা দিয়েছিল। নয়তো মুসলিম সমাজকে নাড়া দেওয়া ওয়াহাবি-ফারায়েজি ও আহলে হাদিস আন্দোলন তো অধিকতর গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার পক্ষেই পরিচালিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের (অর্থা ৎ বাংলাদেশের) হিন্দু কলকাতার রেনেসাঁস আর রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের সংস্কার আন্দোলনের বাইরেই ছিল। ফলে তাদের মধ্যেও চিন্তা ও মানসে পশ্চা ৎ পদতা ও গোঁড়ামির প্রবণতা প্রবল। বাংলাদেশে সমাজ সংস্কারের আন্দোলন এবং সেক্যুলার সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই তা ৎ পর্যপূর্ণ টেকসই পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.