লঞ্চ দুর্ঘটনা-নিরাপদ নৌপথ চাই

মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আবারও মৃত্যুবরণ করতে হলো শতাধিক যাত্রীকে। রাত্রির প্রথম প্রহরে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর ঘাট থেকে রওনা হয়ে এমভি শরীয়তপুর-১ নামের লঞ্চটি যখন গজারিয়ার চর রমজানবেগ এলাকায় মেঘনা নদীর মাঝে, তখন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে। ছোট ছোট স্বপ্ন, আশা, সুখ-দুঃখে বিভোর যাত্রীদের অনেকেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।

কেউবা তন্দ্রাচ্ছন্ন। তখনই এক বিকট শব্দে কাত হয়ে গেল লঞ্চটি। অল্প কিছু যাত্রী তড়িঘড়ি লাফ দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারলেন বটে। কিন্তু অধিকাংশ যাত্রীই ঘুমন্ত অবস্থাতেই তলিয়ে গেলেন ৭০ ফুট পানির নিচে। সেখানেই মর্মান্তিক সলিলসমাধি ঘটল তাদের। জানা গেছে, একটি মালবাহী জাহাজের প্রচণ্ড ধাক্কায় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি। এ নৌরুটে মালবাহী জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাঝরাতে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ তৈরি করে চলেছে মালবাহী জাহাজগুলো। নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক কর্তৃপক্ষ থাকলেও সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে বৃহদায়তন মালবাহী নৌযানগুলো চলছে, তা বোধগম্য নয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী জাহাজটিকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। বিয়োগান্ত এই দুর্ঘটনার পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে সব কর্তৃপক্ষ। নানামুখী তৎপরতা ও তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে। অতীতের সব দুর্ঘটনাতেই এমন ঘটেছে। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়নি। বরং প্রায় প্রতি বছর একই রকম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শত শত মানুষ। ২০০০ সালে চাঁদপুরের ষাটনলে এমভি রাজহংসী দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ১৬২ জন। ২০০২ সালে একই স্থানে এমভি সালাউদ্দিন ডুবে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে ২৪৫ জন। ২০০৩ সালে মেঘনার মোহনায় এমভি নাসরিন ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু হয়েছে ৬৪১ জনের। ২০০৪ সালে এমভি লাইটিং সান, ২০০৬ সালে এমএল শাহ পরাণ দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১১ সালে এমভি কোকো দুর্ঘটনায় আবারও অনেক প্রাণের আলো নিভে যায়। বড় এ দুর্ঘটনাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আছে ছোট ছোট আরও বহু দুর্ঘটনা। এবার এমভি শরীয়তপুর-১ দুর্ঘটনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। কিন্তু এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেন ক্ষণিকের। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর আমরা এমনই একটি সম্পাদকীয় লিখে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারের আহ্বান জানাই। কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো উদ্যোগ আসে না। সবই কাকস্য পরিবেদনা হয়ে দাঁড়ায়। এমন নয় যে, নৌপথে দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা দরকার। বরং সত্য হলো, দুর্ঘটনার কারণগুলো সবার জানা। এ সমস্যাগুলোর আন্তরিক সমাধানই আমাদের নৌপথে চলাচলে নিরাপত্তা দিতে পারে। কোস্ট ট্রাস্ট নৌ দুর্ঘটনার জন্য ১০টি প্রধান কারণ শনাক্ত করেছে। এগুলো হলো: লঞ্চের নকশায় ত্রুটি, চালকের অদক্ষতা, মাস্টার-সুকানির গাফিলতি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, নিরাপত্তা আইন অমান্য, সার্চলাইট ও বাতি না থাকা, চলার পথে দুই লঞ্চের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া লঞ্চ চালনা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে অসতর্কতা, সতর্কতামূলক চিহ্ন ছাড়া নদীপথে মাছ ধরার জাল পেতে রাখা।
নদীপথের সমস্যাও একটি বড় কারণ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথ এখনও গুরুত্বপূর্ণ হলেও দশকের পর দশক নৌপথগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ড্রেজিং হয় না। ফলে চরে আটকা পড়ে দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার ঘটনাও কম নয়। নদীপথে প্রয়োজনীয় নির্দেশক নেই অনেক স্থানে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্তৃপক্ষগুলোর গাফিলতি চরমে পেঁৗছেছে। লঞ্চের ফিটনেস না থাকলে তা দেখার দায়িত্ব যেমন কর্তৃপক্ষের, তেমনি নদীপথে লঞ্চগুলোর তদারকিও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিশাল মালবাহী জাহাজ বেআইনিভাবে বেপরোয়া গতিতে চলছে আর কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে আটকাতে পারছে না_ তা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? নদীপথে চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিআইডবি্লউটিসি, বিআইডবি্লউটিএর। সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোকেও তৎপর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর মধ্যে শক্ত সমন্বয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উচিত, বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এক্ষেত্রে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করা। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা। যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সংস্থাগুলোই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ধারা অব্যাহত থাকা উচিত নয়। দুর্ঘটনা এভাবে এড়ানোর উপায় নেই। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা আসুক, নৌপথ নিরাপদ হোক।

No comments

Powered by Blogger.