লঞ্চভর্তি ১১২ লাশ উদ্ধার by কাজী জেবেল ও মাহবুবুর রহমান

মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে অজ্ঞাত কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যাওয়া যাত্রীবাহী শরীয়তপুর-১ লঞ্চ থেকে গতকাল আরও ৭৫টি লাশ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত দুইদিনে লাশ উদ্ধার হয়েছে ১১২টি। দুর্ঘটনার ৩২ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শরীয়তপুর-১ লঞ্চ নদীর পাড়ে আনা সম্ভব হয়।

এ সময় লঞ্চের ভেতরে স্তূপ আকারে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তল্লাশি চালিয়ে লঞ্চের ডেক ও কেবিন থেকে একের পর এক লাশ বের করে আনেন ডুবুরিরা। গতকাল বিকাল সোয়া ৫টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএ। তবে ঘটনাস্থল ও আশপাশে লাশ ভেসে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে আজ আবারও ওই এলাকায় তল্লাশি চালাবে বিআইডব্লিউটিএ।

এদিকে লঞ্চের প্রায় একশ’ যাত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন জানিয়ে তাদের স্বজনরা শেষবারের মতো প্রিয়জনের লাশ দেখার আশায় নদীর পাড়েই অবস্থান করছেন। তাদের ভাষ্যমতে, লাশ না পাওয়ায় পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থল থেকে ফিরবেন না। এ দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনায় ঘটনাস্থল মেঘনাপাড় ও শরীয়তপুর জেলার গ্রামে গ্রামে শোকের মাতম চলছে। স্বজনহারা মানুষের আর্তচিত্কারে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। উদ্ধারকাজে শৈথিল্যের কারণে নিহতদের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়িও ভাংচুর করেছেন। তবে উদ্ধারকাজে কোনো শৈথিল্য ছিল না বলে দাবি করেছেন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার।
এদিকে দুর্ঘটনার দুইদিন পার হয়ে গেলেও ঘাতক কার্গোটিকে চিহ্নিত বা আটক করতে পারেননি প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কার্গোটি বালুবাহী নাকি তেলবাহী ট্যাংকার তা নিশ্চিত নন তারা। কার্গোটি চিহ্নিত করতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সোর্স নিয়োগ করেছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ওই রাতে কোন কার্গো লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়েছিল তা নির্ণয় করার মতো কোনো কৌশল (ম্যাকানিজম) তাদের জানা নেই। তবে কার্গো টার্মিনাল ও ডক ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। লঞ্চের মাস্টার, ড্রাইভার ও সুকানি মারা যাওয়ায় কার্গো চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। তবে লঞ্চের গ্রিজার বেঁচে আছে। তাকে পাওয়া গেলে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। তারা আরও জানান, মধ্যরাতে শরীয়তপুর-১ লঞ্চের বাম পাশের মাঝ বরাবর আঘাত করায় তা ডুবে যায়। ঠাণ্ডা বাতাস থেকে যাত্রীদের রক্ষার জন্য লঞ্চটির চারদিকে শক্ত করে বেঁধে রাখা মোটা কালো কাপড়ের পর্দা ও জানালার পাশে রাখা মরিচসহ মালামালের বস্তা থাকায় দুর্ঘটনার সময় যাত্রীরা সহজে লঞ্চ থেকে বের হতে পারেননি। আর তাই হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
লঞ্চের সঙ্গে বেরিয়ে এলো লাশের স্তূপ : দুর্ঘটনার ৩২ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুর্ঘটনাকবলিত শরীয়তপুর-১ লঞ্চ সদর উপজেলার উত্তর চরমুশুরা গ্রামে কাছাকাছি এলাকায় নদীর পাড়ে আনতে সক্ষম হয় উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম। দুপুর ২টায় উল্টানো অবস্থায় থাকা লঞ্চটিকে সোজা করা হয়। এ সময় লঞ্চের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে লাশের স্তূপ। ডেক, কেবিনসহ পুরো লঞ্চে অসংখ্য লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। একইসঙ্গে অপেক্ষমাণ স্বজনদের একসঙ্গে বিলাপে ঘটনাস্থলে শোকাতুর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় উদ্ধার কর্মীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। সরেজমিনে দেখা যায়, লঞ্চটি আধোপানিতে থাকা অবস্থায় মৃত মানুষের হাত, পা ও শরীর লঞ্চের জানালা দিয়ে বের হয়ে থাকতে দেখা গেছে। ডুবুরিরা লঞ্চে প্রবেশ করে দেখেন, ডেকের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ ও মালপত্রের স্তূপ। মরিচসহ বিভিন্ন মালের বস্তার ফাঁকেও অনেক লাশ আটকে ছিল। ডেক থেকেও পাওয়া যায় ২০-২৫টি লাশ। পরে ডুবুরিরা লঞ্চের কেবিনগুলোর দরজা ভেঙে তল্লাশি চালায়। প্রায় সব কেবিনেই লাশ পাওয়া গেছে; এমনকি লঞ্চের মাস্টারের রুম থেকেও তিন মহিলা ও এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। বেশিরভাগ লাশই অর্ধগলিত ছিল। স্বজনদের অভিযোগ, এখনও অনেকের লাশ তারা পাননি। সন্দেহ করা হচ্ছে, লঞ্চটিকে তীরে টেনে আনার সময় অনেক লাশ ভেসে গেছে। এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চের টিকিট মাস্টার নড়িয়া উপজেলার ইলিয়াছ হোসেন, লঞ্চের মিস্ত্রি মো. দুলাল এবং লঞ্চের সারেংয়ের কোনো লাশ উদ্ধার করা যায়নি। বিকাল ৫টায় বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার উদ্ধারকাজ সমাপ্তির ঘোষণা দেন। এর আগে সকাল থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠায় নৌকা দিয়ে নদীতে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ করতে থাকেন। তাদের দাবি, গতকাল নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আসার পর উদ্ধারকাজ স্তিমিত হয়ে যায়। সাংবাদিকদের দেখে তারা আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ক্ষতিপূরণ চাই না, লাশটুকু অন্তত উদ্ধার করে দেয়া হোক। লাশ যেন বাড়ি নিয়ে গিয়ে দাফন করতে পারি। তাদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাই লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে না। এদিকে সারারাত নিখোঁজ আত্মীয়স্বজনদের খোঁজে আসা স্বজনরা থাকা এবং খাওয়ার দুর্ভোগে পড়েন। তারা জানান, স্থানীয় জনগণ নাসির মেম্বার ও ইউসুফ হাজীর নেতৃত্বে চরকিশোরগঞ্জ এলাকার জনগণ মহিলাদের বাড়িতে নিয়ে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া রাত থেকে খিচুরি, রুটি-কলা ও পানি স্বজনহারাদের মধ্যে বিতরণ করেন। সকালে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট হকার সমিতি নিহতদের খোঁজে আসা স্বজনদের সকালের নাস্তা দেয়।
যাদের লাশ শনাক্ত করা গেছে : দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ১১২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে যাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তারা হলেন—ইতালি-প্রবাসী প্রীতি আহমেদ (৩২), চাঁদপুরের সালাউদ্দিন (৪০), শরীয়তপুরের সাদেক আলী (৫০), মিলন খান (২৫), হযরত আলী (২৮), শবনম (২০), বদিউন্নেছা (৫০), আলমগীর মালত, হানিফ বাবুল (৪০), বাদশা মাঝি (৩২), তুষার, জাকির হোসেন (২৭), আকরাম, নারয়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রুবেল (২৫), পারভেজ (১৮), দিয়ান (৭), সিফাত ঢালী (১৩), ইসমাইল মাঝি (৪০), আমিন (১৭), রিপন আল মিন্টু (২৮), মিনহাজুল (২৫), বাপ্পী (২৩), সাহারিয়ার সরদার (৩৫), রশিদুন্নেছা (১৬), শাহজালাল (২৫), রিপন (৩৫), রেজা ফারুক (৩৬), ফাহিমা আক্তার (২২), হাসনা বেগম (৬০), কুলছুম (৩২), মিনারা বেগম (২২), আবুল কাশেম (৫০), দেলোয়ার হোসেন (৩০), এসাক কাজী (৩৫), আমজাদ হোসেন (৩৫), বিল্লাল হোসেন (৩৫), আকরাম হোসেন (৩৫), মিজানুর রহমান (৩৬), আলাউদ্দিন (৪০), হাবু বেপারি (৪০), সিনু বেগম (৫৫), মাসুদা বেগম (৪০), হাবিব (৫০), কাদির কবিরাজ (৩৭), মো. সেলিম (৩৮), সেলিম (২০), হাবিবুর রহমান হালদার (৪০), জাহাঙ্গীর ঢালী (২৫), মিনারা (৩৪), নিয়াজ (৬), পলি বেগম (২২), দিদার ইসলাম সরদার (৩৭), শান্তা আক্তার (২৮), সুমন (২৬), শান্ত (১৮), শিমুল চৌধুরী (২০), আবু বক্কর (২৮), সাথী বেগম (২৮), পারভীন (২৬), রায়হান হোসেন (৮), আছিয়া (৫০), আমিনুল ইসলাম (৩৬), সৈকত (২৪), মেজবাউল আলম (৪৫), তামিম (২৫), আলেয়া (৪৫), আবুল কাশেম (৩৫), মোশাররফ আলী (৩০), সানজিদা (১৭),আবুল কাসেম (২৮), রাবেয়া (২১), রহিম দেওয়ান (২৫), রাতুল, মাসুম (৩২), মারুফা (১৫), রায়হান (১৭), ছনিয়া (১৮), সাথী (১৫) ফাহিমা বেগম (৩৫), তুলি (২৫) ইন্দ্রমানিক নড়িয়া, বাংলা ভিশন ক্যামেরাম্যান মাসুদ চৌধুরী (৩৩), মাসুদের স্ত্রী পান্না চৌধুরী, ছেলে মাহির চৌধুরী (৩), আমেনা (৩০) ভাবী হালিয়া, চাঁন মিয়া (৩০), তোফাজ্জল (৩৫), শামীম ফকির (৪০), সাব্বির (১৩), আলী আকবর (৪৫), সৈয়দ মাজহারুল হক (৩২), খোদেজা বেগম (৪৪), শহরবানু (৫০), রাকিব (৩৩), তুষার (৩৫), রিপা (৬), তারিকুল ইসলাম (২৪), মজিবুর রহমান (৩০), লিজা চৌধুরী (২৬), শান্ত (২৫), নওয়াব আলী (২৮), মনির (৩২), দুলাল (৪৫), রাশেদা (৫৫)।
উদ্ধার কার্যক্রমে বিলম্বে ক্ষুব্ধ স্বজনরা : লঞ্চ ও লাশ উদ্ধার কাজে ধীরগতিতে নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনরা প্রশাসনের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাদের অভিযোগ, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর থেকে নানান অজুহাতে লাশ উদ্ধারে বিলম্ব করা হচ্ছে। তাদের ধারণা, ডুবুরিরা ইচ্ছে করেই অনেক লাশ গোপনে ভাসিয়ে দিতে পারেন। এ নিয়ে গতকাল সকালে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। এ সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়ি ভাংচুর করে বিক্ষুব্ধরা। নিখোঁজদের সন্ধানে ঘটনাস্থলে আসা সৈয়দ শাহিনুজ্জামান অভিযোগ করেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামানো ডুবুরীদের ওপর তার পরিবার বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। তাই তারা নিজেদের উদ্যোগে ডুবুরি নামাবেন বলেও জানান। আরেক অভিযোগকারী শরিফ হোসেন জানান, মঙ্গলবার দুপুরে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর থেকে লাশ উত্তোলন কাজ শিথিল হয়ে যায়। নানান অজুহাতে প্রশাসন বেশ কয়েকবার উদ্ধার কাজ স্থগিতও করেছে। জাহিদুল ইসলাম মুকুল জানান, প্রশাসন লাশ উদ্ধারে বিলম্ব করছে নানান অজুহাতে। অথচ দুটি বেসরকারি টিভি এ সংবাদ প্রচার না করে সরকারের টাকা বিতরণের সংবাদ ফলাও করে প্রচার করছে। তার দাবি, লাশ দাফনের জন্য ৩ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে ঘোষণা দিলেও অনেকেই তা নেননি। এবং অনেকেই তা পাননি। স্থানীয় জনগণের দেয়া টাকায় মঙ্গলবার ৩টি লাশ ময়মনসিংহে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা খন্দকার বলেন, উদ্ধার কাজে কোনো ধরনের শৈথিল্য ছিল না। নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিটিএ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেছেন। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক মো. এমদাদুল হক গতকাল আমার দেশ-কে মুঠোফোনে বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে মেঘনা নদী দুই কিলোমিটার প্রশস্ত ও ৭০ ফুট গভীর। বিশাল এ নদীতে পরে পেট ফুলে যদি কোনো লাশ ভেসে ওঠে তা উদ্ধার করার জন্য উদ্ধারকর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তারা আজ দুর্ঘটনা স্থলের আশপাশ এলাকায় আবার তল্লাশি চালাবেন।
এদিকে বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪১ লাশ উদ্ধার হলেও একটি বেসরকারি টিভিতে ১০০ লাশ উদ্ধারের খবর প্রচার হলে মেঘনার পাড়ে থাকা স্বজনরা গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ক্ষেপে যায়। তারা ওই টিভির গাড়ি ভাংচুর করে এবং সাংবাদিকদের মারধর করতে উদ্যত হয়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহীদুল ইসলাম জানান, কোন তথ্যের ভিত্তিতে এ খবর প্রচার করা হয়েছে তা ভেবে পাচ্ছি না।
দুই দিনেও চিহ্নিত হয়নি ঘাতক কার্গো : শরীয়তপুর-১ লঞ্চ দুর্ঘটনার দুই দিন পার হয়ে গেলেও ঘাতক কার্গোটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সোমবার মধ্যরাতে দুর্ঘটনার পরই কার্গোটি পালিয়ে যায়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা ও এ দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উদ্ধার হওয়ার পর লঞ্চ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে কার্গোটি শরীয়তপুর-১ লঞ্চের বাম সাইডের মাঝ বরাবর ধাক্কা দিয়েছে। এতে লঞ্চটি ডান দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়। ৭০ ফুট পানির নিচেও ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন ডুবুরিরা। কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চের বাম পাশে ফাটল দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, লঞ্চের একমাত্র গ্রিজার বেঁচে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাকে পাওয়া গেলে দুর্ঘটনার বিবরন ও কার্গোটি চিহ্নিত করা সহজ হবে। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ক্যাপ্টেন কে এম জসিম উদ্দিন সরকার গতকাল মুঠোফোনে আমার দেশ- কে বলেন, গভীর রাতে ধাক্কা দেয়ার পরই পালিয়ে যাওয়ায় কার্গোটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। টাইম-টেবিলসহ বিভিন্ন কারণে যাত্রীবাহী লঞ্চ চিহ্নিত করা যত সম্ভব এক্ষেত্রে তত কঠিন। কার্গোটি চিহ্নিত করার কোনো মেকানিজম (কৌশল) নেই। তবে সোর্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আশা করি চিহ্নিত করতে পারব। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক মো. এমদাদুল হক ঘটনাস্থল থেকে আমার দেশ-কে বলেন, লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়েই কার্গোটি পালিয়ে যাওয়ায় ধরা সম্ভব হয়নি। কর্গোর সন্ধানে বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তদন্ত রিপোর্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে বিআইডব্লিউটিএ : শরীয়তপুর-১ লঞ্চ দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিআইডব্লিউটিএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এ পর্যন্ত যতগুলো নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোর তদন্ত হয়েছে। দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটে মেঘনা নদীতে ডুবে যাওয়া এমভি বিপাশা লঞ্চে দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে শরীয়তপুরে লঞ্চের দুঘর্টনার বিষয়ে গঠিত তদন্ত রিপোর্টও কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এতে আরও বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে শরীয়তপুর-১ লঞ্চটি সোমবার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। রাত ২টার দিকে লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে মালবাহী কার্গো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। সংঘর্ষের পর পণ্যবাহী কার্গোটি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নৌযান দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। যুগ্ম সচিব বায়তুল আমীনকে আহ্বায়ক করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন জসিম উদ্দিন সরকারকে প্রধান করে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর এবং মতিয়ার রহমানকে সদস্য (অর্থ) আহ্বায়ক করে বিআইডব্লিউটিএ থেকে এ তদন্ত কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে।
২৭ লাশ উদ্ধার করলেন ডুবুরি আবুল খায়ের : নৌ-দুর্ঘটনায় দুই দিনে ২৭টি লাশ উদ্ধার করলেন ডুবুরি আবুল খায়ের। গতকাল তিনি ১৬টি লাশ উদ্ধার করেন। এর আগে মঙ্গলবার ১১টি লাশ উদ্ধার করেছিলেন। ডুবুরি আবুল খায়ের জানান, মাত্র ২২ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন ডুবুরির কাজ। আর গত ২২ বছর ধরে এ কাজ করে একটুও ক্লান্ত হননি ৪৪ বছরের আবুল খায়ের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা আবুল খায়ের ডুবুরি হিসেবে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ২০০৫ সালে জাতিসংঘের পুরস্কার পান। এছাড়া বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ২০০৭ সালে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পুরস্কার এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পান। ব্যক্তি জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা আবুল খায়ের জানালেন, দুর্ঘটনার পর স্বজনরা লাশের জন্য অপেক্ষা করেন। তখন লাশটি তুলতে পেরে মনে হয় ওই স্বজনদের অন্তত শেষ মুহূর্তের সান্ত্বনা দিতে পারছি। আর সেটুকুর জন্যই থাকে আমার প্রতিটি ডুব। উদ্ধার কাজের এক ফাঁকে আবুল খায়ের জানালেন ২০০৫ সালে আরিচায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি তিনিই প্রথম শনাক্ত করেছিলেন।
শোকাহত মানুষের পাশে এলাকাবাসী : লঞ্চডুবির ঘটনায় গত দুই দিন মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীর তীরে লঙ্গরখানায় অবস্থানরত লঞ্চ যাত্রীদের স্বজনদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আপনজন হারা স্বজনরা যাতে থাকা ও খাওয়ায় কষ্ট না পান, সে লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেন এলাকাবাসী। ঢাকার মালিবাগ থেকে স্বজনের খোঁজে আসা সৈয়দ শাহিনুজ্জামান জানান, গজারিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আহসান উল্লাহসহ বিভিন্ন ব্যক্তি থাকা ও খাওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা করেছন। তিনি জানান, স্থানীয় লোকজন আমাদের যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তা ভোলার নয়। সদর উপজেলা আ.লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া, ইমামপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ জিন্নাহসহ একাধিক ব্যক্তিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

No comments

Powered by Blogger.