বুকফাটা আহাজারিতে ভারী মেঘনার পার by শরিফুল হাসান

পানির নিচ থেকে ডুবুরিরা একে একে তুলে আনছেন লাশ। নদীর তীরে সারি বেঁধে রাখা হচ্ছে লাশগুলো। হারানো স্বজনের খোঁজে আসা ব্যাকুল মানুষ ছুটে যাচ্ছেন এসব লাশের দিকে। দুরুদুরু মনে একেকজন হন্যে হয়ে খোঁজেন চিরচেনা মুখ।

কোনো লাশ শনাক্ত হলেই স্বজনের বুকচাপা কষ্ট উথলে ওঠে বাঁধভাঙা মাতমে। দুই দিন আগের সেই চেনামুখ এখন কেবলই স্মৃতি। এ স্মৃতির আগুনে পুড়তে পুড়তে তাঁরা আপনজনের লাশ নিয়ে ফিরছিলেন নিজ নিজ ঠিকানায়।
গতকাল বুধবার সারা দিন এই ছিল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনাপারের চিত্র। স্বজনহারা মানুষের বুকফাটা আহাজারি আর লাশের গন্ধে ভারী ছিল মেঘনার পার। গজারিয়ার মানুষ নদীর তীরে একসঙ্গে এত লাশ কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। গতকাল এক দিনেই সেখানে উদ্ধার করা হয় ৭৬টি লাশ।
সকালে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম মিলে লঞ্চটি ওপরে তুলে আনতে শুরু করে। এ সময় ডুবুরিরা একের পর এক লাশ তুলে আনতে থাকেন। দুই দিন ধরে অপেক্ষায় থাকা লোকজন পেতে শুরু করেন স্বজনদের লাশ।
সকাল থেকে বাবার লাশের অপেক্ষায় ছিলেন ছেলে মুরাদ হোসেন (২৪)। বেলা ১১টার দিকে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। পানিতে নেমে সাঁতরে নিজেই খুঁজতে থাকেন হারিয়ে যাওয়া বাবাকে। দুপুর ১২টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তরুণ করুণ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন, ‘ওই তো আমার মা!’ আলামিন নামের তরুণটি জানান, ঢাকায় গাড়ি চালান তিনি। তাঁকে দেখতেই তাঁর মা ঢাকায় আসছিলেন।
দুপুর ১২টার পর লাশ উদ্ধারের কাজ দ্রুত এগোতে থাকে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ওপরে তোলার পর কিছু ব্যাগ দেখে চিৎকার দেন হাবিবুর রহমান ফকির। জানান, এসব ব্যাগ তাঁর স্বজনদের। কিছুক্ষণ পর তিনি একে একে খুঁজে পান তাঁর ভাই শামীম ও ভাবিসহ পরিবারের চারজনের লাশ। হাবিবুর জানান, তাঁদের পরিবারের আরও একজন নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের সবার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল।
দুপুরের দিকে ওই লঞ্চে গিয়ে একটি ল্যাপটপ দেখে কাঁদতে শুরু করেন গোলাম মোস্তফা নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, এটি তাঁর ভাই সানবীরের ল্যাপটপ। একটু পরই তিনি পেয়ে যান নিষ্প্রাণ ভাইটিকে। তখনো তাঁর আরেক ভাই রুবেল নিখোঁজ।
দুই দিন ধরে বাবা আবুল হাশেমের লাশ খুঁজছেন ছেলে মুরাদ হোসেন। দুপুর পর্যন্ত তিনি লাশ খুঁজে পাননি। একসঙ্গে পরিবারের আট সদস্যের লাশ খোঁজেন মোহাম্মদ মানিক। কাঁদতে কাঁদতে জানান, তাঁর পরিবারের নয়জন ছিল লঞ্চে। প্রিয় বোন আকলিমার লাশ এখনো পাননি।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উদ্ধার করা লাশগুলো সারি বেঁধে রাখা হয় নদীর তীরবর্তী চর কিশোরগঞ্জে। সেখানে চলছে লাশ শনাক্তকরণ। হাজার হাজার মানুষ আসছেন, পোশাক আর চেহারা দেখে লাশ শনাক্ত করছেন।
অনেক ছোটাছুটির পর মেয়ে মিনারার (২০) লাশ খুঁজে পান বাবা মকবুল হোসেন। লাশ শনাক্ত করতে গিয়ে বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘মাত্র আট মাস আগে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবুল কাশেমের লাশ নিতে এসেছিলেন মামা আউয়াল হোসেন। স্ত্রী কুলসুম বেগমের (৩২) লাশের সন্ধানে এসেছিলেন স্বামী আবদুল মালেক। একসময় লাশ শনাক্ত করে নির্বাক হয়ে বসে পড়েন তিনি।
গতকাল সন্ধ্যার পরও মেঘনার পারে ছিল শোকাহত হাজারো মানুষের পদচারণ। কেউ কেউ লাশ নিয়ে ফিরছিলেন শরীয়তপুরের দিকে। কেউবা তখনো প্রিয়জনের লাশ পেতে ব্যাকুল।

No comments

Powered by Blogger.