মহাজোট সরকার বনাম মহাসমাবেশ by লুৎফর রহমান রনো

আমাদের দেশে মহাসমাবেশ নতুন কিছু নয়। এ দেশের রাজনৈতিক ভাষা, তাও নতুন নয়। নেতাদের মুখ নিঃসৃত শব্দাবলি, শাসানি, ধমকানি এমন পর্যায়ে পতিত হয় যে ভাষার শ্লীলতাই বজায় থাকে না। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মনের কথা বা চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। আমাদের রাজনীতিকদের ভাষা পাঠ করলে তাঁদের মনের সংকীর্ণতা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

তদুপরি রাজনীতিকদের ভাষাজ্ঞানের স্বল্পতা তো রয়েছেই। ক্ষমতাসীন দলের, জোটের হোক বা বিরোধী বলয়ের হোক, নেতা-নেত্রীদের মনের সংকীর্ণংতা, স্বার্থপরতা, জ্ঞানের দৈন্য প্রভৃতি কারণে যে সব ক্ষতি সাধিত হয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তা আমরা জেনেশুনেই মেনে নিই। নিরুপায় দেখে আসছি ক্ষমতার লক্ষ্যে সামন্ত যুগের জোতদারদের মতো জোরজবরদস্তি, লাঠি ঘোরানো আর অশ্রাব্য কথাবার্তা। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, এই পরিস্থিতি পাল্টানোর কোনোই সম্ভাবনা সুদূর ভবিষ্যতেও দুর্লক্ষ্য।
যেকোনো অংশ, দল বা জোট ক্ষমতায় যায় জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য। এই পাঁচটি বছর বিরোধীদের দাঁত চেপে অন্তত ধৈর্য ধারণ করা উচিত। আমরা দেখি পরাজয়ের ধাক্কা কোনো মতে সামলে নিয়ে বছর যেতে না যেতেই সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধী গোষ্ঠীর চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। আর তা এমন মাত্রা স্পর্শ করে যে সরকারের পদত্যাগ দাবি করতে থাকে। তাতে দেশজুড়ে শুরু হয় জনগণের দুর্ভোগ তথাকথিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের অবাস্তব কর্মকাণ্ডের কারণে। অথচ তাদের ভালো করেই জানা যে পাঁচ বছরের আগে সরকার পদত্যাগ করবে তো না-ই, কোনো কিছুই হবে না। কিন্তু এসব তাদের করতে হয়। কারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ফিরিয়ে আনা ও দলের সাংগঠনিক কাজে গতি অব্যাহত রাখার জন্য। এসব বিরতিহীনভাবে করতে হলে সরকারের 'দোষত্রুটি' খোঁজা ও 'টেনেহিঁচড়ে' ক্ষমতা থেকে নামানোর হুমকি-ধমকি দিতে থাকা দেশসেবার অংশ হয়ে ওঠে। কর্মী বা নেতা, ক্যাডাররা এসব করতে বাধ্য থাকে, কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে যে যেমন পেরেছে 'মালপানি' কামিয়েছে, ভবিষ্যতেও সুযোগ আসবে। তাই ন্যায়নীতি, গণতন্ত্র, আইন, সংবিধান, দেশ-জনতা এসবের ধার ধারে না কেউ। রাজনীতির মতো মুনাফা আর কোনো পেশা বা ব্যবসাতে নেই। সংসদে বসে রাজনৈতিক মতানৈক্য বা জাতীয় সমস্যা সমাধানে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জাতীয় নির্বাচনের সার্থকতা বজায় থাকত। যাঁদের জনগণ ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে তাঁদের তাই করা উচিত। জনগণের দাবিদাওয়া, সুখ-দুঃখ, দুর্ভোগ- সব কিছু নিজেদের কাঁধে নিয়ে সংসদে বসার জন্যই মানুষ নেতা নির্বাচন করে। শত শত কোটি টাকার নির্বাচন হয়। আর হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতার জোগান দিতে। যদি সভা-সমাবেশ, হরতাল, মিছিল প্রভৃতি কর্মসূচি ও জনগণের ভোগান্তি ১২ মাসই থাকবে, তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে জাতীয় অপচয় কেন হবে এত?' বিশ্বের অন্যতম সেরা স্থাপত্য সৌন্দর্যের সংসদ ভবন ও এর আনুষঙ্গিক উপাদান প্রতিষ্ঠা করা কি স্রেফ প্রতীকী? দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন প্রতিষ্ঠা করে লুটপাট করার একটি উপায় মাত্র! তার চেয়ে নয়াপল্টন ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর অফিস কি যথেষ্ট নয়?
একটি গরিব দেশ বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধা, জীবনের মান বৃদ্ধির কোনো চিন্তাই তথাকথিত রাজনীতিকদের নেই। যে দলই আসে, যে নিয়মনীতিই জারি করে, দেখা যায় ধনী, ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমান্তরালভাবে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি, বিলাস বাড়ছে। সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে ভাষণ-বিবৃতি দিয়ে দেশের মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যাতে জনগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ না পায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে কি না তা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ফয়সালা হোক সংসদে। সরকার তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করুক নির্বিঘ্নে- এটা আমাদের কাম্য। এর আগে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে, আন্দোলন জোরদার করার যে অপচেষ্টা, তাহলে সরকার একে অবশ্যই বলবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর আন্দোলন। কেননা মহাসমাবেশে অসংখ্য কর্মীদের বুকে বাঁধা ছিল রাজাকারদের ছবি। দেশের বারোটা বাজিয়ে হলেও বিএনপি চায় ক্ষমতা। আর তাতে দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে হলেও জামায়াত চায় আওয়ামী লীগের পতন, তাদের নেতাদের বাঁচাতে। এরই মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অর্থহীন সংসদ ভবন, আমাদের সংবিধান ও জাতীয় নির্বাচন, অতীতের অর্জন ও আজকের সাধারণ মানুষের বিপন্নতা। বিপন্নতা এই অর্থে, এই মহাসমাবেশেও লাখো মানুষের উপস্থিতি ঘটে। ক্ষমতায় রয়েছে যারা, তারা বেশ কিছু ভালো কাজ করেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে পারেনি। ক্ষমতাসীন বিভিন্ন কণ্ঠের বেফাঁস কথাবার্তাও তাদের অতীতের মতো কাল হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতাসীনদের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার কারণে যদি মানুষ পুরনো অন্ধকারের রাজনীতির ফাঁদে জড়িয়ে যেতে থাকে, তাহলে সত্যিই কি বিপন্ন নয় দেশ? আর এর দায়দায়িত্ব এড়ানো অসম্ভব তাদের, যারা ক্ষমতায়।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.