মেঘনার কান্না দিকে দিকে

গজারিয়ায় লঞ্চডুবির ঘটনায় মানুষের কান্না কেবল মেঘনার তীরেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, লৌহজং, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায়। যে এলাকার যাত্রীরা ছিল ওই লঞ্চে, সেখানেই চলছে আহাজারি। মৃত ও নিখোঁজ যাত্রীদের ঘরে ঘরে চলছে মাতম। মৃতদের নানা আবেগঘন স্মৃতিচারণায় ভারী হয়ে উঠছে একেকটি বাড়ির পরিবেশ।

প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে দিলীপ কুমার মণ্ডল, শরীয়তপুরের আসাদুজ্জামান জুয়েল, রূপগঞ্জের রাসেল আহম্মেদ ও লৌহজংয়ের মাসুদ খান।
শান্তার সব দুঃখ শান্ত : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মাঝিপাড়া ও বরপা এলাকার ২০ জন লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ২০ জনের মধ্যে চারজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে নববধূসহ আরো পাঁচজনকে। বাকি ১১ জন নিখোঁজ রয়েছে।

রূপগঞ্জের মাঝিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মাঝিপাড়া এলাকার কামাল উদ্দিনের বিয়েতে ১৭ জন বরযাত্রী নিয়ে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ সদর এলাকায় যায় তাঁর আত্মীয়স্বজনরা। সেখান থেকে নববধূ শান্তাকে নিয়ে রূপগঞ্জে ফেরার পথে সোমবার গভীর রাতে ঘটে দুর্ঘটনা। কামালের ভাবি সালেহা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, লিটন মিয়া, রিনা আক্তার, বাচ্চু মিয়া ও পাঁচ মাসের শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নববধূ শান্তা, রুবেল মিয়া ও পারভেজ মিয়াকে মৃত উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন বর কামাল, ফারুক, মিনারা, রফিক, রাফিয়া, আছিয়া, মাসুমসহ আরো ১০ জন।
জানা গেছে, নববধূ শান্তার জীবন শুরু হয়েছিল দুঃখের মধ্য দিয়ে। ক্ষণিকের সুখ পেলেও তা স্থায়ী হয়নি কখনোই। শান্তার সব দুঃখ ঢেলে দিয়ে গেলেন পালক মা নাজমা বেগমের বুকে। নাজমা বেগম শান্তাকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায়। বারবার শান্তার কথা মনে করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি। জন্মের পর ছয় মাস বয়সে শান্তা বাবাকে হারান। নিঃস্ব হয়ে যান তাঁর মা। শান্তাকে লালন-পালনে তাঁর মায়ের সক্ষমতা ছিল না। অভাবের তাড়নায় মা তেলীপাড়া গ্রামের মতিন কাইতের কাছে শান্তাকে দত্তক হিসেবে পালতে দেন। সেই সূত্রেই মতিন কাইতের স্ত্রী নাজমা বেগম শান্তার পালক মা। শান্তা জানতেন তাঁর বাবা-মা মতিন কাইত ও নাজমা বেগম। আপন মেয়ের মতোই শান্তাকে ১৬ বছর মা-বাবার স্নেহে বড় করেন তাঁরা। এর মধ্যে ঢাকায় চাকরি নেন শান্তার গর্ভধারিণী মা। কিছু টাকা জমিয়ে ও মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে একসময় দুবাই চলে যান তিনি। তিন মাস আগে তিনি বিদেশ থেকে এসে শান্তাকে নিয়ে যেতে চান। শান্তা প্রথমে যেতে চাননি। বিয়ে দেওয়ার নাম করে তাঁর খালার বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার মহিষার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে তেলীপাড়া গ্রামে মতিন কাইতের বাড়িতে একটি সালিসও হয়। সালিসের সিদ্ধান্তে শান্তাকে গর্ভধারিণী মায়ের কাছেই দেওয়া হয়। কিন্তু শান্তা পালক বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে চাননি। গত রবিবার শ্রীনগরের আটপাড়া গ্রামের কামাল হোসেনের সঙ্গে শান্তার বিয়ে হয় খালার বাড়ি মহিষারে।
রূপগঞ্জের বরপা এলাকার সাংবাদিক সাত্তার আলী সোহেল জানান, তাঁর ফুফু রোকসানা বেগম শরীয়তপুরের কার্তিকপুর এলাকায় তাঁর অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে যান স্বামী দিদারুল ইসলাম ও মেয়ে আনজুমানকে নিয়ে। আনজুমান ও দিদারুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেলেও ফুফু রোকসানা নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
বাবার পরে ছেলে : রাশাদ ইবনে হেলাল সৈকত (২০) ঢাকা কলেজে অনার্সে ভর্তির উদ্দেশ্যে তিন বন্ধুর সঙ্গে একই লঞ্চে উঠেছিলেন সুরেশ্বর থেকে। সোমবার গভীররাতে মেঘনায় লঞ্চডুবিতে মৃত সৈকতকে গতকাল বুধবার বিকেলে উদ্ধার করেছেন ডুবুরিরা। তাঁর বাবা হেলাল উদ্দিন হেলু ছিলেন লঞ্চের সারেং। ১৫ বছর আগে যে লঞ্চের সারেং ছিলেন, সেই লঞ্চেই আগুন লেগে মারা যান হেলু।
সৈকতের চাচা শাহনেওয়াজ ওমর মিলন কালের কণ্ঠকে জানান, সৈকত গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন। ঢাকা কলেজে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সোমবার রাতে তিন বন্ধুর সঙ্গে সুরেশ্বর ঘাট থেকে এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চে ওঠেন। লঞ্চটি মেঘনায় ডুবে যাওয়ার পর সঙ্গী তিন বন্ধু প্রাণে বেঁচে গেলেও সৈকত বাঁচতে পারেননি। দুই দিন অপেক্ষার পর গতকাল বিকেলে ডুবুরিরা সৈকতকে উদ্ধার করেন ৭০ নম্বর লাশ হিসেবে।
স্ত্রীর ভিসা নিয়ে না-ফেরার দেশে : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শামিম ফকির দেড় মাস আগে স্ত্রী পলিকে নিতে দেশে আসেন। মঙ্গলবার রাতের ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা তাঁদের। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বিদেশ নয়, চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আর বিদায় জানাতে যারা সঙ্গে ছিল তারাও হলো সহযাত্রী। গতকাল শামিম, স্ত্রী পলি, পলির মা, পলির বড় বোনের জামাই নাহিদ ও নাহিদের মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছেন ডুবুরিরা।
রামভদ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিপ্লব শিকদার জানান, ১৪-১৫ বছর ধরে প্রবাস জীবন যাপন করেছেন শামিম ফকির। বছর তিনেক আগে ঢাকার লালবাগের মেয়ে পলির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে নিতেই মূলত তাঁর বাংলাদেশে আসা। স্ত্রী পলির ভিসা হচ্ছিল না। দেড় মাস আগে স্ত্রীর ভিসা হাতে পেয়ে আর দেরি করেননি শামিম। স্ত্রীকে নিয়ে যেতে দেশে আসেন।
একমাত্র বেঁচে যাওয়া ভগি্নপতি দুলাল দেওয়ান বলেন, 'আমি কিভাবে লঞ্চ থেকে বের হয়েছি জানি না।' এরপর আর কিছু বলতে পারছেন না তিনি।
বুধবার বিকেলে ডুবুরিরা শামিম, স্ত্রী পলি, শাশুড়ি, ভায়রা নাহিদ ও তাঁর মেয়ের লাশ উদ্ধার করেন। লাশ নিয়ে কার্তিকপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে স্বজনরা। কান্নার সঙ্গে চলছে লাশ দাফনের প্রস্তুতি।
চলছে লাশ খোঁজার পালা : শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান (৫০) নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর বড় ভাই বাবুল হোসেন জানান, হাবিবুর রহমান ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চে যাচ্ছিলেন।
এমন অনেকের আত্মীয়-পরিজনরা নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানে গতকাল সকাল থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ বিভিন্নভাবে নদীতে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। বহু যাত্রী এখনো নিখোঁজ। ভেদরগঞ্জ উপজেলার নজরুল ইসলাম শিকদার (৫০), তাঁর মেয়ে পলি (২০) ও নিপা (৮), খোদেজা বেগম (৫০), মাসুদ চৌধুরী (৩০), তাঁর স্ত্রী পান্না চৌধুরী ও একমাত্র ছেলে মাহির (৩) নিখোঁজ রয়েছে। ভেদরগঞ্জের বাবুলের ভাই হাবিবুর রহমান ও বাবা আলম মিয়া পাগলের মতো খুঁজছেন ছেলেকে।
মেঘনা পাড়ে চলছে স্বজনহারাদের মাতম। বেঁচে যাওয়া নড়িয়া উপজেলার হাকিম নামের এক যাত্রী বলেন, 'রাতে প্রায় সব যাত্রীই ঘুমিয়ে ছিল। তেলবাহী কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর ব্যাপক হুড়োহুড়ি শুরু হলে আমি জানালা দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিই।' তিনি আরো জানান, লঞ্চটি শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল। আবদুল করিম নামের এক যাত্রী বলেন, 'দুর্ঘটনার সময় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিতালী-৩-এর যাত্রীরা এক শিশুসহ ৩০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে। তবে আমার সঙ্গে থাকা আমার ভাই সেলিমকে (২২) এখনো পাইনি।' ঢাকা থেকে স্বজনদের খোঁজে আসা আবুল কালাম জানান, লঞ্চে তাঁর ১২ জন আত্মীয় ছিল। তাদের মধ্যে মিতালী লঞ্চে চারজন উঠতে পারলেও আটজন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ঢাকা থেকে আত্মীয়দের খুঁজতে আসা নাসির নামের একজন বলেন, তাঁর পাঁচজন স্বজন ছিল লঞ্চটির কেবিনে। কিন্তু তাদের কারো সন্ধান এখনো মেলেনি। তাদের মধ্যে তাঁর বোন, ভাগি্ন ও ভাগ্নের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল। নিখোঁজ রেজাউল করিম (৩৫) ঝালকাঠি থেকে স্বজনকে খুঁজতে আসেন মেঘনায় পাড়ে।
বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের সিনিয়র ক্যামেরাম্যান মাসুদ চৌধুরী (৩০) নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাঁর ছোট ভাই মামুন চৌধুরী জানিয়েছেন। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মামুন চৌধুরী ভাইয়ের খোঁজ না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, গ্রামের বাড়ি নড়িয়া থেকে সোমবার তিনি এই লঞ্চে ঢাকায় রওনা হন।

No comments

Powered by Blogger.