বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৪১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আনিসুর রহমান, বীর প্রতীক ডুবিয়ে দিলেন ফেরি ও স্টিমার হালকা শীতের রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নেমে পড়লেন পানিতে। তাঁদের নেতৃত্বে আনিসুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ।

সেগুলো নিয়ে ঠান্ডা পানির মধ্যে সাঁতরে যেতে থাকলেন সামনের দিকে। প্রায় ঘণ্টা খানেক সাঁতরে পৌঁছালেন লক্ষ্যস্থলে। সেখানে নোঙর করা চারটি ফেরি ও একটি স্টিমার। নিঃশব্দে তাতে লাগালেন বিস্ফোরক। তারপর দ্রুত সরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সেগুলো পানি তোলপাড় করে ফাটতে শুরু করল। ঘাটে থাকা পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা ছোটাছুটি করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকল। নিমেষে পানিতে ডুবে গেল ফেরি ও স্টিমার। এ ঘটনা বাহাদুরাবাদে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে।
বাহাদুরাবাদ জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম। এই ঘাটের বিপরীতে ফুলছড়িঘাট। তখন এই ঘাটের গুরত্ব ছিল অপরিসীম। ভারতের মেঘালয়, কোচবিহার ও দার্জিলিং থেকে নদীপথে এই এলাকা হয়ে দেশের ভেতর ঢুকতেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সে জন্য বাহাদুরাবাদে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারি। ঘাটের চারপাশে ছিল পাহারার ব্যবস্থা। জুলাই মাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল (নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) বাহাদুরাবাদে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি বগি, ইঞ্জিন, বার্জ ও পন্টুন ধ্বংস করেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাহাদুরাবাদ—ফুলছড়িঘাটের যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক করে ফেলে।
এরপর আনিসুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দলের ওপর ভার পড়ে বাহাদুরাবাদঘাটে অপারেশনের। তাঁদের এই দায়িত্ব দেন কাদেরিয়া বাহিনীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম)। এবার তাঁরা ভিন্ন কৌশল নেন। সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ না করে ঘাটে থাকা ফেরি ও স্টিমার বিস্ফোরকের সাহায্যে ডুবিয়ে দেন।
রাতের অন্ধকারে ২৪টি বিস্ফোরকসহ ব্রহ্মপুত্র নদে নেমে প্রায় আড়াই মাইল সাঁতরে তাঁরা লক্ষ্যস্থলে যান। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তীরে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য থাকেন। আনিসুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা স্থলযোদ্ধা হয়েও সফলতার সঙ্গেই সব ফেরি ও স্টিমারে বিস্ফোরক লাগান। সবগুলোই পানিতে নিমজ্জিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা সেগুলো উদ্ধার করে আর চালু করতে পারেনি। এরপর নৌপথে পাকিস্তানিদের বিচরণ কমে যায়। কারণে ওই এলাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ চলাচল করা সহজ হয়ে পড়ে।
আনিসুর রহমান ১৯৭১ সালে চাকরি করতেন, কর্মরত ছিলেন নরসিংদীর আলীজান জুট মিলে। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২-২৩। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজ এলাকায় যান। পরে মায়ের অনুমতি নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। পরে কাদেরিয়া বাহিনীর অধীনে। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আনিসুর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪২৬।
আনিসুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের স্থল গ্রামে। বর্তমানে তিনি মাগুরার এ আর জুট মিলে কর্মরত। তাঁর বাবার নাম মকবুল হোসেন, মা আমিনা বেগম। স্ত্রী শামসুন নাহার। তাঁর তিন ছেলে।
সূত্র: আনিসুর রহমান, বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com