আবার লঞ্চডুবি-নৌব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করতে হবে

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌপথ যে এখনো নিরাপদ নয়, তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল। প্রতিবছর এখানে নৌদুর্ঘটনা ঘটে। নৌদুর্ঘটায় মানুষের প্রাণ যায়। কিন্তু নদীপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতা যদি নিশ্চিত করা যেত, তা হলে প্রতিবছর এভাবে নৌদুর্ঘটনায় প্রাণহানি হতো না।

সোমবার দিবাগত রাতে মেঘনা নদীতে ঘটে এ লঞ্চ দুর্ঘটনা। লঞ্চের যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে লঞ্চটিতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। আগের দুদিন নৌপথে কোনো নৌযান চলাচল না করা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দুর্বল সাফাই হতে পারে। কিন্তু আসলেই কি আমাদের নৌপথে চলাচলকারী নৌযানগুলো ঝুঁকিমুক্ত? অনেক ত্রুটি রয়েছে আমাদের নৌপথে চলাচলকারী নৌযানগুলোতে। অধিকাংশ নৌযান সঠিক নকশা ও নিয়ম মেনে তৈরি করা হয় না। অনেক নৌযানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বয়া নেই। অন্যদিকে চালকদের অদক্ষতার ব্যাপারটি তো আছেই। এগুলো দেখার কেউ নেই। অদক্ষ চালকদের হাতে নৌযান তুলে দিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ানো হচ্ছে। অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত চালক না থাকলে যেকোনো নৌযানই ঝুঁকিপূর্ণ। আবার নৌপথে সংকেত ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। অনেক সময়, বিশেষ করে রাতের বেলায় চলাচলকারী নৌযানগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। সোমবার রাতের দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানা গেছে, একটি তেলবাহী কার্গোর সঙ্গে এই নৌযানটির ধাক্কা লাগা। প্রশ্ন উঠতে পারে, তেলবাহী কার্গোটি সম্পর্কেও।
প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে নানা কথা শোনা যায়। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা হয়। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। সোমবার রাতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানেও গঠন করা হয়েছে তিনটি তদন্ত কমিটি। আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর কারণ অনুসন্ধানেও একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির রিপোর্টে সব সময় কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সেই সুপারিশ কতটুকু কার্যকর হয়েছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেসব রিপোর্টে যে সুপারিশ ছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে! যাদের এসব দেখার কথা, সংশ্লিষ্ট সেই বিভাগ কি এ সম্পর্কে সচেতন ও আন্তরিক? প্রশ্ন উঠছে, এ কারণেই যে এখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হয়নি। এটা বর্ষা মৌসুমও নয়। এই শুষ্ক মৌসুমেও যদি নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়, তা হলে বর্ষা মৌসুমে কী হবে? আসন্ন বর্ষা মৌসুমের কথা ভেবে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
সোমবারের দুর্ঘটনায় নিহতের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। মৃতদেহ দাফনের জন্যও অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাবর এটা করা হয়। কিন্তু একটি জীবনের দাম কি মাত্র ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা যায়? একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের জন্য বয়ে আনে অনেক বেদনা ও কান্না। সড়কপথের মতো নৌপথের নিরাপত্তাহীনতা অনেক পরিবারকে অসহায় করে দিয়েছে। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অদক্ষ চালকদের কাছে যেমন নৌযান ছেড়ে দেওয়া যাবে না, তেমনি অতিরিক্ত যাত্রী বহন থেকেও বিরত থাকতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হবে না, এ বিষয়টি নৌযান মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। নৌপথ ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটি আছে, তা দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি তদারকি অবশ্যই জোরদার করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.