কর্নেল তাহের হত্যা-৩-যেকোনো স্থানে অবিচার সর্বত্রই ন্যায়বিচারের হুমকি by লরেন্স লিফশুলজ

৪. ১৯৭৭ সালের সেই ‘বিদ্রোহের’ সময় আসলেই কী ঘটেছিল, আজ ৩০ বছরের বেশি সময়ের পরও সেটা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে আছে। অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, এটা আদতে কোনো বিদ্রোহই ছিল না। আসলে এটা ছিল সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে জিয়ার শত্রুদের ‘টোপ দিয়ে বের করে আনার’ গোয়েন্দা অভিযান।

আনাড়ি হাতে অনেক ছড়িয়ে জাল পাতা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, দেশের সামরিক বিচারের বিধিমালার লঙ্ঘন ঘটিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাইরে অজস্র মানুষের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল।
২০০৬ সালে আমি প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকায় এক নৈশভোজে মিলিত হই। দুজন বিখ্যাত সাংবাদিক ও মইন চৌধুরীর বন্ধু সাবেক এক সেনা কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, লন্ডনে (বাংলাদেশ দূতাবাসের) সামরিক অ্যাটাশে থাকার সময় থেকে আমি তাঁকে চিনি। তখন প্রায়ই আমরা নৈশভোজে বসতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর কাজ হলো আমার ওপর চোখ রাখা। আমিও বললাম যে ব্যাপারটা পারস্পরিক। তা হলেও মূলত তিনি আমার কাছ থেকে রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ে কী পড়বেন, সে বিষয়ে পরামর্শ চাইতেন। আমার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁকে বই ধার দেওয়া।
২০০৬ সালের ওই সন্ধ্যায় আলোচনা ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে গড়াল। সে সময় জিয়ার অনুরোধে মইন লন্ডন থেকে ফিরে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হয়ে বসলেন। সিদ্ধান্তটা বিচক্ষণোচিত ছিল না।
সেই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের বলেছিলেন, ২০০ জনের মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন তাঁর হাত দিয়ে হয়েছিল; কিন্তু প্রকৃতভাবে মোট কতজন সেনাকে হত্যা করা হয়েছিল, তা তিনি জানেন না। তাঁর হিসাবমতে, তাঁদের সংখ্যা শত শত। ওই সব মানুষের কেউই সুষ্ঠু বিচার পাননি বলে সেই সন্ধ্যায় মইন স্বীকার করেছিলেন। সেনাদের আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার থাকলেও তাঁদের তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল আরজি করার অধিকারও ছিল। সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল তাঁদের। এসব ঘটনায় নিজের ভূমিকার জন্য তিনি অনুতাপ প্রকাশ করেন।
সেই নৈশভোজের অল্প কিছুদিন পর আমি ঢাকায় তাঁর বাসায় দেখা করতে চেয়ে ফোন করি। আমাদের মধ্যে আরও বিশদ আলোচনা হয়। নৈশভোজে তিনি যা বলেছিলেন, তা-ই সেদিন আরও বিস্তারিতভাবে জানান। চলে আসার সময় আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের সেই বিপর্যয়ের সময় সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে কৃতকর্মের জন্য তিনি সত্যি সত্যিই অনুতপ্ত।
সুতরাং, এখানে আমরা সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলকে পেলাম। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে ফাঁসিতে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা সব সেনাকে সেনাবাহিনীর বিচারবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। হুকুমদাতার ভূমিকায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। মইন বলেছেন, জিয়া যা কিছু করেছেন, নিজের ইচ্ছামাফিক করেছেন।
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ের বিষয়ে সত্য ও ন্যায়বিচার কমিশন গঠন করা হলে জেনারেল মইন স্বেচ্ছায় সেখানে সাক্ষ্য দিতে আসতেন। আমার মতে, তিনি খোলামনে তাঁর ভূমিকার দায়দায়িত্ব স্বীকার করতেন এবং অনুশোচনা প্রকাশ করতেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের এই অধ্যায়ের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন এমন লেখক হাতে গোনা। আমার জানামতে, আতাউস সামাদই প্রথম এই গণপ্রাণদণ্ডের বিষয়ে লিখেছিলেন। তবে সবচেয়ে বিশদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিলেন জায়েদুল আহসান পিন্টু। ঘটনার ২০ বছর পর ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে ভোরের কাগজ-এ তাঁর প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা তিনি আরও বিস্তৃত করে প্রকাশ করেন তাঁর বই একটি সেনাঅভ্যুত্থানের রহস্য: ফাঁসির দড়িতে সেনা।
জায়েদুল হাসান পিন্টু সারা দেশ ঘুরে বিভিন্ন জেলে যাঁদের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল, সেই সব সেনার তালিকা সংগ্রহ করেন। তিনি সে সময় সেনা কমান্ডের সঙ্গে জড়িত অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও নেন। কিন্তু এঁদের কেউ নিহত সেনাদের প্রকৃত সংখ্যাটি বলতে পারেননি। যা ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই ঘটেছে। অনেকগুলো ঘটনা থেকে মনে হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং সযত্নে সত্য আড়াল করার বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল। তাই সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের ভাষ্য ও ঘটনার পরপরই তৈরি করা তালিকার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অসংগতি মিলতে থাকে।
যেমন: আহসানের কাছে কুমিল্লা কারাগারের এক জল্লাদ দাবি করেন, তিনি ৯৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁদের কাছে কোনো নথিপত্র নেই। আহসানের মতে, ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ বিভাগ (আইএসপিআর) থেকে প্রচারিত বক্তব্যে ‘বগুড়া সেনাবিদ্রোহের’ সঙ্গে জড়িত ৫৫ জন সেনাকে ফাঁসি দেওয়ার কথা বলা হলেও বগুড়া কারাগারে মাত্র ১৬ জনের নাম পাওয়া যায়। আহসানকে বলা হয়েছিল, বাকিদের হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু রাজশাহী কারাগারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেখানে কোনো নথিপত্র নেই।
আহসানের ভাষ্যমতে, ১৯৭৭ সালে দুই হাজারেরও বেশি সেনাকে ৭ থেকে ২৬ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ‘বিচারের মুখোমুখি’ করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, বেশির ভাগ বিচার শুরু হয়েছিল ৭ অক্টোবর এবং প্রাণদণ্ড শুরু হয় ৯ অক্টোবর। এ দুই দিনের মধ্যে এসব মানুষকে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করার কথা। আহসান আমাদের আরও জানান এবং জেনারেল মইনও আমাকে বলেছিলেন, এসব ছাড়াও জেনারেল জিয়া ৭ অক্টোবর নতুন বিধিমালা জারি করেন, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনে আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া কিংবা প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রহিত করা হয়। সামরিক বাহিনীর জন্য নির্ধারিত বিচারপ্রক্রিয়া লঙ্ঘিত হয় এতেও।
অবধারিতভাবে, সে সময় সামরিক বিধিমালার অধীনে যথাযথভাবে গঠিত কোনো ট্রাইব্যুনাল বাস্তবত ক্রিয়াশীল ছিল না। ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রাণদণ্ডের শিকার হওয়া সেনাদের সংখ্যাটি আহসান পেতে পেরেছিলেন সেই সময়ে ঢাকার নবম ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল মীর শওকত আলীর কাছ থেকে। নিহত সেনাদের বিষয়ে এটাকেই সর্বনিম্ন মাত্রা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই সংখ্যাটি হলো এক হাজার ১৩০। আসল সংখ্যাটি আসলে কত? কেউ জানে না। আহসানের বিশ্বাস, শত শত সেনাসদস্যকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল কোনো প্রমাণ না রেখে। মীর শওকতের দেওয়া সংখ্যার বাইরেও যেমন অনেকে থেকে যেতে পারেন, আবার সবাই হয়তো এর অন্তর্ভুক্ত হতেও পারেন।
আবু তাহেরের ‘বিচার’টি যদি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা ‘জাল, মিথ্যা ও বানোয়াট’ ঘোষিত হয়ে থাকে, তাহলে এটা কী?
হয়তো এম কে আনোয়ার অথবা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান দিতে পারেন। তাঁরা কি বলবেন, এই সরকার দ্য সানডে টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সন ম্যাকব্রাইড ও লরেন্স লিফশুলজকে ভাড়া করেছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানি করার জন্য?
আনোয়ার ও আলমগীর অভিযোগ করবেন কি, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ এক্সিকিউশনস: এ ডিসক্রিপান্সি’ (১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮) প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের যে কর্মকর্তা বিবেকের তাড়নায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করেছিলেন, তিনিও ভাড়া করা দালাল ছিলেন? অথবা সেই ১৯৭৮ সালে এর পেছনে কোনো সংস্থা কাজ করেছিল?
সমস্যা এটাই যে সামগ্রিক কালপঞ্জি আনোয়ার ও আলমগীর সাহেবের অভিযোগের যুক্তিকাঠামোর পক্ষে ঠিকমতো যাচ্ছে না। কেন? কারণ, গণহারে প্রাণদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, ১৯৭৭-৭৮ সালে। তাহলে জনাব আলমগীর, ৩০ বছর আগে এসব মানুষ কীভাবে জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানির উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়েছিলেন?
আনোয়ার কবীর নির্মিত শক্তিশালী প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে রক্তস্নানও কি আনোয়ার ও আলমগীর সাহেবের মতে বানোয়াট? প্রাণদণ্ডের সেই ‘মহাঝড়ের’ সময় নিখোঁজ সেনাদের পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কবীর। সেই সব পরিবার এখনো জানে না তাদের সন্তান, ভাই ও স্বামীদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল।

৫.
গত মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষ্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি বাংলাদেশে আসি। তখন বেশ কিছু সংবাদপত্রের কর্মীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের কাছে আমি একটা প্রশ্নই তুলতাম। আমি একদমই বুঝতে পারি না, এত বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষের মধ্যে তাহেরের মামলা সম্পর্কে আগ্রহ এত তীব্র কেন, কেন তা থেকে এত কথা উঠে আসছে?
আলবত সুপ্রিম কোর্টের রায় মানুষের মধ্যে যে আলোচনা তুলেছিল এবং যে বাড়তি মনোযোগ কেড়েছিল, তাতে আমি খুশি হয়েছিলাম। ১৯৭৬ সালের মর্মান্তিক অবিচার এবং গুমরানো যন্ত্রণার এত মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কথা আমার মনে বাজছিল। এসব স্মরণে রাখলে তাহেরের মামলার রায় উল্টে দেওয়া আসলেই ‘স্বপ্ন সত্যি হওয়ার’ মতো ঘটনা। তবু আমি পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না, এই মামলা কেন ও কীভাবে জনমানসকে আঁকড়ে ধরেছিল। ব্যাপারটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। যাঁদেরই দেখা পেয়েছি, তাঁদের কাছেই আমি এর ব্যাখ্যা খুঁজেছি।
সবচেয়ে মনকাড়া জবাবটি আমি পেয়েছিলাম প্রথম আলোর বিরাট সভাঘরে মধ্যাহ্নভোজের সময়। পত্রিকাটির সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ কর্মীই সেদিন সেখানে আলোচনার জন্য জমায়েত হয়েছিলেন। প্রথম আলোর তরুণ সাংবাদিকদের একজন ফারুক ওয়াসিফ যেভাবে প্রশ্নটির জবাব দিলেন, তাতে আমার চোখ খুলে গেল। তিনি বললেন, তাঁর প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের ইতিহাসজুড়ে ছিল অনেক অনেক ‘শূন্যস্থান’। যেসব আখ্যানের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন, আবশ্যিকভাবেই সেসবের মধ্যে দেশটির ইতিহাসের অনেক পৃষ্ঠাই উধাও হয়েছিল। তাহেরের কাহিনি সেই ‘উধাও ইতিহাসেরই’ একটা যুগের ছবি তুলে ধরে।
সুপ্রিম কোর্টের সেই মামলার তলায় নিহিত অনিবার্য ইস্যুগুলোও ছিল সেই ‘উধাও’ ইতিহাসের অন্যতম। তাহেরের প্রাণদণ্ড এবং গোপন বিচার সমাধা করার জন্য যেসব বেআইনি পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সেসবের পর্যালোচনা মানুষকে মনের দরজা খুলে অতীতের পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ দিয়েছে। মর্মবাণীর দিক থেকে সুপ্রিম কোর্টের এই অবদান কেবল একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রদানের থেকে অনেক বেশি কিছু। আদালত এখানে ‘ইতিহাস পুনরুদ্ধারের’ কাজকে এগিয়ে দিয়েছে।
ওয়াসিফ আরও যা বলেছিলেন তা হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে তরুণতর প্রজন্ম স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত শ্রদ্ধা করার মতো খুব কম মানুষকেই দেখতে পায়। নিষ্প্রভ ব্যক্তিত্বরাই এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভারাক্রান্ত করে আছেন। ওয়াসিফের দৃষ্টিতে, পরিষ্কারভাবেই তাহের ছিলেন সেই মানুষ, যিনি এ দেশের ‘মঙ্গল করতে চেয়েছেন’। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এবং এর পরের দিনগুলোতে তিনি অটুট সাহস ও দারুণ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন।
তাহের এখনো মহৎ আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন। তিনি সেই মানুষ, যিনি দরিদ্রদের মুক্তির জন্য ভয়কে জয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ছিল গরিমাময়। ১৯৭১-এ যেসব মহৎ আদর্শের জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন সেসবের প্রতি। তরুণ প্রজন্ম যেমন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে তাকাতে চায়, তিনি ছিলেন তেমনই এক মানুষ। আমার মনে হয় ওয়াসিফ এটাই বলেছিলেন। অনেকটা এ রকমই।
একটি শেষ কথা আমি বলতে চাই। তাহের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ২২ মার্চের রায়ের কাছে পৌঁছেছে যে পথ, সেই পথ রচনা করে গেছেন একদল সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি। তাহেরের প্রাণদানের ক্ষতির পর শুরুতে তাঁদের গভীর বেদনা সইতে হয়েছে, সইতে হয়েছে নিরন্তর নিঃসঙ্গতা। পরিণতিতে তাঁদের মনে জন্মেছে এক গোঁয়ার জেদ, দুই প্রজন্ম ধরে তা বহমান থেকেছে। আজ যা অর্জিত হয়েছে, তা কারও একার অবদান নয়। এই সফর শুরু করেছিলেন অল্প কিছু মানুষ, অন্যরা পথের মাঝে শামিল হয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা অল্পই ছিল, কিন্তু তাঁরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
আমি বিশ্বাস করি, আবু তাহেরের পক্ষে ন্যায়বিচারের জন্য যাঁরা বহু বছর ধরে সংগ্রাম করেছেন, তাঁরা বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড কথিত সেই পথেরই আগুয়ান প্রতিভূ, যা মানবসভ্যতার সামনে এগোবার একমাত্র পথ। ‘সন্দেহ রাখবেন না কখনো’ তিনি বলেছিলেন, ‘চিন্তাশীল, দায়বদ্ধ নাগরিকদের ছোট্ট একটি দলই দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে। বাস্তবিকই, এটাই ঘটেছে সব সময়।’
[শেষ]

আবু তাহের সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন আমার লেখা:
http://www.thedailystar.net/2006/07/23/d607231501118.htm
২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধ
লরেন্স লিফশুলজ: মার্কিনঅনুসন্ধানীসাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.