আমিনবাজার ট্র্যাজেডি-ছয় ছাত্রের মৃত্যু: একটি অপ্রিয় ব্যবচ্ছেদ by শেখ হাফিজুর রহমান

গত ১৯ জুলাই সকালে পত্রিকা হাতে নিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল। আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের বাসিন্দাদের হাতে ছয় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু। নিহত ছাত্রদের স্বজনেরা ছাড়াও হাজার হাজার মা-বাবা ও সংবেদনশীল মানুষ বিষণ্ন ও নির্বাক হয়ে গেছেন। ছয়জন ছাত্রকে শত শত গ্রামবাসী এক ঘণ্টা ধরে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তাও আবার পুলিশের

সামনে! উপস্থিত এক দারোগা এই বলে গ্রামবাসীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন, ‘আপনারা সবাইকে মেরে ফেললে তো সমস্যা হবে। একজনকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন।’
পুলিশের সক্রিয় তৎ পরতায় (!) বেঁচে গেলেন আল-আমিন। বাকি ছয় ছাত্রকে গ্রামবাসী গদির চালা থেকে বাঁশ খুলে, ইট নিয়ে, খুঁটির লাঠি নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করল। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা? কতটা আদিম ও হিংস্র হলে শত শত গ্রামবাসী ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে? আমাদের সমাজের নানা স্তরে কি এমন করেই প্রাগৈতিহাসিক নির্মমতা বিরাজ করছে? সভ্যতা ও মানবিকতার একটা সহনীয় পর্যায়ে যেতে আরও কত দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?

দুই.
দুই সপ্তাহ ধরে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের অধিবাসীরা ডাকাত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। ফলে ডাকাত ঠেকাতে তারা নিজেদের উদ্যোগে ১২ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করে। গ্রামবাসী নিজেরাও সতর্ক থাকে এবং কোনো রকম বিপদের ইঙ্গিত পেলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তা প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়। শবে বরাতের রাতে সাত ছাত্রকে ডাকাত বলে সন্দেহ হওয়ায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে ছয় ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ডাকাত আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে ও ডাকাতি প্রতিরোধে গ্রামবাসীর পুলিশ ও র‌্যাবের সহযোগিতা নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু গ্রামবাসী কেন তা নেয়নি? এ প্রশ্নের দুটি উত্তর রয়েছে। এক. আমিনবাজার ও এর আশপাশের এলাকায় রয়েছে প্রচুর অবৈধ বালু উত্তোলনের ব্যবসাকেন্দ্র। আরও রয়েছে নিম্নাঞ্চল ভরাট করে জমি দখলের কারবার। এখানকার ট্রাক টার্মিনালের পাশে মাদক ব্যবসার একটা কেন্দ্র রয়েছে। ফলে আমিনবাজার ও বড়দেশী গ্রামসহ এর আশপাশের এলাকার চরিত্রটি হচ্ছে অপরাধপ্রবণ। আর অবৈধ ব্যবসা ও মাদক বিক্রয় ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অধিবাসীরা আইনের আশ্রয় নেয় না। ফলে তারা পুলিশ বা র‌্যাবও পছন্দ করে না। দুই. পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থার অভাব শত বছরের পুরোনো একটি রাষ্ট্রীয় সংকট। ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন ও বাংলাদেশি শাসনে পুলিশ কখনোই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ১৮৫৭ সালে সিপাহি-বিদ্রোহের পর জনগণের ন্যায়সংগত আন্দোলন দমন করতে ও ব্রিটিশ রাজকে নিরাপদ রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শাসক যে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ১৯৬১ সালের যে পুলিশ আইন তৈরি করেন, সেই আইন ও কাঠামো অনুযায়ী এখনো পুলিশ চলছে। পুলিশ সম্পর্কে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯০২ সালে যে ফ্রেজার কমিশন (Fraser Commission) গঠন করেন, ওই কমিশন পুলিশকে অদক্ষ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও দুর্নীতিপরায়ণ বলে চিহ্নিত করে। ফ্রেজার কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার পর ১০৯ বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশের চরিত্র কিন্তু বদলায়নি। ফলে পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা ফিরে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এ আস্থার সংকটের কারণে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় ও সুপার মার্কেটে সংশ্লিষ্ট অধিবাসী বা ব্যবসায়ীরা নিজেরা চাঁদা দিয়ে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করে গ্রাম, মহল্লা বা সুপার মার্কেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।

তিন.
শবে বরাতের নামাজ শেষে সাত তরুণ আমিনবাজারের পেছনের এলাকায় নেশা করতে গিয়েছিল বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। পুলিশ যদি জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করে, তাহলে তা সংবিধান ও সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী অবৈধ। স্বীকারোক্তির বিষয়টি যদি সত্যি না হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ওই সাত তরুণ শবে বরাতের পবিত্র রাতে কেন আমিনবাজারের মতো অপরাধপ্রবণ এলাকায় গিয়েছিল? শবে বরাতের রাতের পবিত্রতা, নামাজের আত্মসমর্পণ ও সঠিক পথে চলার আহ্বান কি ওই তরুণদের নেশার প্রলোভন থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি? নেশার সর্বগ্রাসী থাবা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় বাংলাদেশের সমাজকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। শুনেছি বিপুলসংখ্যক ডাক্তার, বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তা নাকি গাঁজা ও ফেনসিডিলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন! নেশার সর্বগ্রাসিতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের সমাজ দিনে দিনে আরও বেশি অসুস্থ, অস্থির ও হিংস্র হয়ে উঠবে।
কোনোভাবেই ছয় ছাত্রের মৃত্যুকে জায়েজ করা যায় না। এ মৃত্যুগুলো নিষ্ঠুর ও বেদনাদায়ক। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। কেননা, শবে বরাতের রাতে ডাকাতি করার ঘটনা বেশ বিরল। আর গ্রামবাসীর যদি ওই সাত তরুণকে ডাকাত বলে সন্দেহ হয়ে থাকে, তাহলে তারা তাদের আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারত। পুলিশের প্রতি আস্থার সংকট যতই থাক, বিচারব্যবস্থা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক, আইন নিজের হাতে তুলে নিলে পরিণতিতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যই বেড়ে যাবে।

চার.
বিখ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম Anomie বা আইনহীনতার কথা বলেছেন। বিশেষ করে, Organic Society বা শহুরে সমাজ, যেখানে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বাস করে, সেখানে আইনের কাজ হচ্ছে পর্যাপ্তভাবে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আইন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের আচরণ ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে সে সমাজে আইনহীনতা দেখা দেবে বলে ডুরখেইম দেখিয়েছেন। ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার দ্বন্দ্বে নানা অচলাবস্থা এ সমাজের আইনহীন ও নৈরাজ্যিক অবস্থাকেই স্পষ্ট করে তোলে। আর এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় আদিম হিংস্রতা ও পাশবিক বর্বরতা, তাহলে সে সমাজকে কি করে সুস্থ ও সুশীল বলব?
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.