খাদ্যনিরাপত্তা-কৃষি বিপ্লবের ধানের সন্ধানে by মুশফিকুর রহমান

বাংলাদেশের অন্যতম উদ্বেগের বিষয় কৃষিজমি দ্রুত কমছে। ছোট্ট এ দেশটির প্রকৃতি ও পরিবেশ নানা ধরনের ফসল উ ৎ পাদন, সবুজ আচ্ছাদন সৃষ্টি এবং বছরে একাধিক ফসল উ ৎ পাদনের উপযোগী। কিন্তু দেশের মানুষ বাড়ছে খুবই দ্রুত। মানুষের প্রয়োজনে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকান, বাজার, কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে হচ্ছে।

এতে সংকুচিত হচ্ছে কৃষিজমি। সরকারি হিসাবে বছরে কৃষিজমি কমছে চাষযোগ্য জমির ১ শতাংশ। মানুষ বাড়লে বেশি পরিমাণ ফসল ফলাতে হয়, সে জন্য বেশি পরিমাণ জমি চাষের আওতায় আনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা: এক দিকে মানুষ বাড়ছে, উল্টো দিকে কৃষিজমি কমছে। তা ছাড়া পৃথিবীজুড়ে পরিবেশের নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। আমাদের দেশে নদীগুলো খরায় পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে, আবার বর্ষায় বন্যা ও প্লাবন দেখা দিচ্ছে। আবহাওয়ার অস্থিরতা, উষ্ণায়ন, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ফসলের মাঠে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ও খরার ফলে জমির উ ৎ পাদনক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
বাড়তি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির জোগান এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ফসল, ফলমূল, মাছ, দুধসহ নানা পুষ্টি-উপাদান উ ৎ পাদনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে সামনে এনেছে। নতুন গবেষণা, উন্নততর প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পরিবেশের বাস্তবতায় সহনীয়ভাবে সেগুলোর প্রয়োগ দাবি করছে। আমাদের জন্য সেগুলোই টেকসই প্রযুক্তি, যা স্বল্প জমিতে, স্বল্প ব্যয়ে ব্যবহারের উপযোগী, মানুষের জন্য সহজ ও নির্ভরযোগ্য এবং পরিবেশের জন্য অনুকূল। এমনই প্রযুক্তির সন্ধান চলছে দেশজুড়ে। বায়ো-টেকনোলজি, টিস্যুকালচার তেমনই এক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই রোগবালাইমুক্ত উন্নত জাত ও উচ্চফলনশীল আলু, কলা, স্ট্রবেরি, নানা জাতের ঔষধি গাছ ও ফুলের ক্লোন চারা উ ৎ পাদনে সমর্থ হয়েছেন। গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উ ৎ পাদিত লাখ লাখ চারাগাছ মাঠপর্যায়ে বাড়তি ফসলের পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বজায় রেখে ফসল দিচ্ছে। বায়ো-টেকনোলজি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উ ৎ পাদিত আলুবীজ ও কলার চারা রোগমুক্ত উন্নত জাতের হওয়ায় মাঠে কৃষক অল্প জায়গায় বেশি ফলন পাচ্ছেন এবং রাসায়নিক ও কীটনাশক কম ব্যবহার করছেন।
বায়ো-টেকনোলজির সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রযুক্তি আরও স্বল্প ব্যয়ে, সহজ ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর তাগিদও তৈরি হয়েছে। সে কারণে নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক আলো, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও মূল্যবান রাসায়নিক উপাদাননির্ভরতার বদলে সূর্যালোক, স্বাভাবিক তাপ ও আর্দ্রতার পরিবেশে এবং সুলভ বিকল্প উপাদান ব্যবহার করে আলুবীজ ও কলার উন্নত জাতের ক্লোনবীজ, চারা উ ৎ পাদন এবং মাঠপর্যায়ে তা ব্যবহারে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই সফল হয়েছেন। বাংলাদেশে এই উদ্ভাবনের নেতৃত্বে আছেন ব্র্যাক বায়ো-টেকনোলজি ল্যাবরেটরির টিস্যুকালচার বিশেষজ্ঞ এফ জে জাপাতা। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর মানুষ ড. জাপাতা দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ করেছেন, এখন কাজ করছেন গাজীপুরের ব্র্যাক বায়ো-টেকনোলজি ল্যাবরেটরিতে। তিনি ইতিমধ্যে কম খরচে টিস্যুকালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করে উ ৎ পাদিত কলা ও আলুর রোগমুক্ত উচ্চফলনশীল চারা ও তা থেকে ফলন পাওয়ার সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন।
কৃষি গবেষণায় এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ প্রতিকূল পরিবেশ, বন্যা, লবণাক্ততা, খরাসহিষ্ণু এবং স্বল্প সময়ে চাষযোগ্য বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ধানের জাত নির্বাচন ও মাঠপর্যায়ে সেগুলোর সফল চাষ। এ জন্য চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উন্নত জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করে সেগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় কীভাবে উ ৎ পাদনের উপযোগী হতে পারে, তার গবেষণা চলছে। এ দেশের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন বিভিন্ন দেশের আবিষ্কারগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবনের। ইতিমধ্যে লবণাক্ততাসহিঞ্চু ও বন্যায় টিকে থাকার মতো কিছু জাতের ধান আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছেন প্রচলিত ১২০ দিন দৈর্ঘ্যের উচ্চফলনশীল ধান চাষের জীবনচক্রকে সংকুচিত করতে। গাজীপুরে ব্র্যাকের গবেষণাকেন্দ্রের মাঠে চেষ্টা চলছে উচ্চফলনশীল অল্প পানিতে ও স্বল্প সময়ে চাষোপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবনের।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন খুবই আশাবাদী, শিগগির এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য অর্জিত হবে। তিনি আরও মনে করেন, ফসল বহুমুখীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত মানুষের নিবিড় সম্পৃক্তি, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সরবরাহ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের অর্থ ও প্রযুক্তি-সহায়তা।
আমাদের পরিবেশে উচ্চফলনশীল ধান চাষের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হলো সেচ। সেচের পানির অধিকাংশই আসে ভূগর্ভ থেকে। ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে ধান চাষ কেবল ব্যয়বহুলই নয়, পরিবেশের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারীও বটে। এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে ধান চাষের বিকল্প নেই, কিন্তু শুধু ধান চাষ করলেই আমাদের চলবে না। সবজি, ডাল, তেলবীজ, ফলমূল ইত্যাদির চাষও করতে হবে; কিন্তু কৃষিজমির পরিমাণ তো সীমিত এবং তা ক্রমশ করে যাচ্ছে। এ পটভূমিতে বৈরী আবহাওয়ায় উচ্চফলনশীল, কিন্তু অল্প সময়ে চাষোপযোগী ধানের জাত সন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অল্প সময়ে জমি থেকে ফসল উ ৎ পাদনের প্রযুক্তি আয়ত্ত করা। এ জন্য টেকসই গবেষণা ও উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োজন। ১২০ দিনের জায়গায় ৯০ দিনে ফলানোর উপযোগী ধানের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হলে এবং সেই ধান অপেক্ষাকৃত স্বল্প সেচেই ফলানো গেলে কৃষিতে সত্যিই একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব।
বিশ্বের উষ্ণায়ন, পরিবেশের দ্রুত বদলে যাওয়া এবং একই সঙ্গে বিপুুল জনগোষ্ঠীর ভারে ন্যুব্জ আমাদের এই ছোট্ট দেশে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবনমান উন্নয়নের নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশ্রয়ী সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। তবে সে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হতে হবে আমাদের পরিবেশ ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমদানিনির্ভর ও ব্যয়বহুল কৃষিপ্রযুক্তি আমাদের দেশে জনপ্রিয় করা কঠিন।
ড. মুশফিকুর রহমান: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.