দেখে এসে লেখা-‘রাজপথ বিএনপি-জামাতরে ইজারা দিয়ে কি ঘুমায়ে থাকব?’ by মশিউল আলম

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের দৃশ্য ছিল অন্যান্য দিনের মতোই; যানবাহন ও লোক চলাচল স্বাভাবিক। কিন্তু বেলা দেড়টায় ১৪ দলের জনসভা দেখতে যাব বলে যখন আবার সেই রাস্তায় নেমে আসি, তখন যানবাহন কমে গিয়েছে।

নগরের মধ্য দিয়ে যে বাস-মিনিবাসগুলো যাত্রীবোঝাই হয়ে চলাফেরা করে, সেগুলো বিরল। রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে একটি মিছিল: তাদের কণ্ঠে জয়বাংলা স্লোগান। ১২ মার্চ বিরোধী চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশের দিন রাস্তায় মিছিল দেখতে পাইনি। বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, তাঁরা খণ্ড খণ্ডভাবে সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখে পড়ার আশঙ্কায় মিছিল করেননি। অবশ্য পুলিশের কয়েকজন সদস্য বলেছিলেন, তাঁরা কাউকেই কোনো বাধা দেননি।
যানবাহন বিরল, তবু একটা মিনিবাস পাওয়া গেল, যেটি গাবতলী থেকে রওনা দিয়েছে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যাওয়ার নিয়ত করে। বাসের কন্ডাক্টর নিশ্চিত নন, যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যেতে পারবেন কি না। এক যাত্রী বললেন, যত দূর পর্যন্ত যাওয়া যায়, সেটাই লাভ। ক্ষোভের সঙ্গে আরেকজন বললেন, এক দিন আগেই কী ভোগান্তিই না গেল। আরেকজন যোগ দিলেন, এখন থেকে এই রকমই চলবে। সামনে আরও ভোগান্তি আছে।
কাকরাইল মোড়ে পুলিশ; বিজয়নগরের গুলিস্তান-অভিমুখী সড়কটিতে যানবাহন ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত। পুলিশ কাকে যেতে দিচ্ছে, কাকে আটকাচ্ছে—বোঝার উপায় নেই। বাঁ পাশের ফুটপাত ধরে গুলিস্তানের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়, দুই পাশের দোকানপাট খোলা, কিন্তু ক্রেতাদের ভিড় নেই। মোটরযানের খুচরা যন্ত্রাংশের দুটি পাশাপাশি দোকানের দরজায় টুলে বসে গল্প করছেন দুজন বিক্রয়কর্মী। ব্যবসা-বাণিজ্যের কী অবস্থা?—এই প্রশ্নে একজন হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, কোনো অবস্থা নাই। বেলা বাজে আড়াইটা, এখনো বউনি হয় নাই। পাশের জন বললেন, আজ পুরা একটা সপ্তাহ, কেনাবেচা নাই বললেই চলে। বিএনপির মহাসমাবেশের কয়েক দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে এই মন্দাদশা। আরও কিছু দূর এগোনোর পর ইলেকট্রিক লাইটিং সরঞ্জামের একটি দোকানে ঢুকে দেখা গেল, হাই তুলছেন দোকানি। একজন ক্রেতাও নেই। বেচাকেনার অবস্থা জানতে চাইলে তিনি পরিহাসের হাসি হেসে বললেন, আর কেন জিজ্ঞাসা করেন? দেখতেই তো পাচ্ছেন।
একটি মোটর ওয়ার্কশপের সামনের রাস্তায় তিন-চারজন কর্মী নিয়ে বসে আছেন জয়নাল আবেদীন, ব্যবসা-বাণিজ্যে গত এক সপ্তাহের মন্দাদশা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘আমার এই ৫৫ বছরের জীবনে কোনো দিন দেখি নাই, সরকার নিজেই হরতাল করে।’ হরতাল? আমার এই জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমাদের জন্য এটা তো হরতালই। তিন-চারজন কর্মচারীকে আমার বেতন দিতে হয়। কাজকাম নাই, কীভাবে চলবে? এই ছেলেগুলারে আমি বেতন দিব কীভাবে?’
পুরানা পল্টনের মোড়ে এক পাশে জিপিও, অন্য পাশে সচিবালয় রেখে যে প্রশস্ত সড়ক গুলিস্তানের দিকে চলে গেছে, তার মুখেই লোহার ব্যারিকেড, তার সামনে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। তার পর থেকে জিরো পয়েন্টের দিকে সড়কজুড়ে জনসভায় যোগ দিতে আসা লোকজন। ভিড়ভাট্টা, ঠেলাঠেলি নেই; একটা উৎসবের আমেজে সংগঠনের কর্মীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজনের সঙ্গে কথা হলো, তিনি জানালেন, তাঁরা আট-দশটি বাস নিয়ে আজ সকালে এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ১২ তারিখের মহাসমাবেশে যোগ দিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি কুষ্টিয়া থেকে আসতে পেরেছিলেন? তিনি সরলভাবে বললেন, ‘না, গাড়িঘোড়া ছিল না।’ জানতে চাইলাম, কাজটা কি ঠিক হয়েছিল? তিনি আর কিছু না বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু চাঁদপুর থেকে আসা কয়েকজন যুবক বললেন, সরকার ১২ মার্চ ঢাকার সঙ্গে চাঁদপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল—এই তথ্য ঠিক নয়। বলেন, ‘বাসের মালিকেরা যদি বাস না চালায়, সরকার কী করতে পারে?’ সরকার বিরোধী জোটকে কোনো বাধাই দেয়নি বলে তিনি দাবি করলেন।
জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে বাঁয়ে ঘুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট পর্যন্ত একটা চক্কর দিয়ে ১৪ দলের জনসভাটির লোকসমাগম পরিমাপের একটা চেষ্টা করা গেল। মাইকে তখন একটি কণ্ঠ বলছে, ‘আজকের এই লাখো জনতার মহাসমুদ্রে..’, বেলা তিনটা, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের যেখানে মঞ্চ বানানো হয়েছে, তার সামনে রাস্তার এক পাশে সামান্য ফাঁকা রেখে সোজা সদরঘাটের দিকে সড়ক ও ডানে সচিবালয়মুখী সড়কে জনসমাবেশ ঘটেছে, এবং দুদিক থেকেই মিছিল নিয়ে আসা অব্যাহত রয়েছে। জিপিওর সামনের রাস্তার একাংশে আড়াআড়ি বাঁশের ব্যারিকেড, এক কোণে নিরাপত্তামূলক গেট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্য ও ছাত্রলীগের কর্মীরা জনসভার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট। একে একে মন্ত্রী ও নেতারা আসছেন, ওই গেট দিয়ে ঢুকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে জনসভা শুরু হয়ে গেছে; একে একে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিচ্ছেন ১৪ দলের শরিক বিভিন্ন দলের নেতারা। তখনো মিছিল আসছে, দূর দূর থেকে ভেসে আসছে মিছিলের শব্দ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নেতা-কর্মীরা এসে যোগ দিচ্ছেন। এভাবে বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে মাইকে একের পর এক বলা হচ্ছে বিভিন্ন জেলার নাম। ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে গেছে দুই পাশের সড়ক; মাইকে বারবার বলা হচ্ছে ‘ব্যানারগুলো নামিয়ে ফেলুন’, কিন্তু তেমন কাজ হচ্ছে না। কেউ ব্যানার নামাতে চায় না; নিজ নিজ এলাকা ও এলাকার নেতার নাম প্রদর্শনের সুযোগ ছাড়তে যেন কেউ রাজি নন।
জনসভার বক্তাদের অধিকাংশই বক্তৃতায় প্রাথমিক সম্বোধনের পর মূল বক্তব্য শুরু করছেন বিরোধী দল ও খালেদা জিয়ার নামের উচ্চারণ দিয়ে। খালেদা জিয়ার নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে, ততবার আর কারোর নামই নয়। পরিষ্কার হলো, এই জনসভা একটি প্রতিক্রিয়া: বিরোধী জোটের ‘শো-ডাউনে’র জবাব। যদিও একাধিক নেতা-কর্মী আমাকে এ রকম বোঝাতে চেয়েছেন, এটা কোনো পাল্টা কর্মসূচি নয়; মার্চ মাসজুড়েই আওয়ামী লীগ অনেক কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে ১২ মার্চের বিরোধী জোটের সমাবেশের আগেই। পত্রিকায় এটাকে পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে, কিন্তু তা ঠিক নয়।
কিন্তু সরকারি দল হয়ে জনভোগান্তিমূলক এসব কর্মসূচি পালনের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না, এমন প্রশ্ন করলে একজন বললেন, ‘কেন? বিএনপিই শুধু শো-ডাউন করতে পারে? আমরা পারি না? আমরা কি রাজপথ বিএনপি-জামাতরে ইজারা দিয়ে ঘুমায়ে থাকব?’ মনে হয়, সরকারি দল যে সরকারের মধ্যে একদম দ্রবীভূত হয়ে মিশে যায়নি, সেটা জানান দেওয়ার তাগিদ রয়েছে এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে।
জনসভার বক্তাদের বক্তব্যের প্রায় পুরোটাই বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডকেন্দ্রিক। সরকার বা ক্ষমতাসীন জোটের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, এমনকি প্রতিশ্রুতির পরিমাণও ছিল কম। বক্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপি ১২ মার্চ মহাসমাবেশ করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে; নাশকতা করে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কায়দায় তালেবানি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেননসহ আরও কয়েকজন বক্তা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিএনপি যেভাবে চাইছে, সেভাবে আর হবে না। এ বিষয়ে কোনো আপস নেই। রাশেদ খান মেনন খুব দৃঢ়ভাবেই বললেন, ‘বেগম জিয়া ৯০ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন, কিন্তু ৯০০ দিন আন্দোলন করেও আপনাদের আশা পূর্ণ হবে না, হবে না হবে না।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন—বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মাইকে সোচ্চার কণ্ঠে এই ঘোষণা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানমুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা: ‘হাসিনা তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘জয় বাংলা’, ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম’ ইত্যাদি স্লোগান ছাপিয়ে মনে হলো, ১৪ দলের আজকের এই জনসভার মূল বার্তা ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’। বিএনপি-জামায়াতের ‘আরব বসন্ত’ আনার আকাঙ্ক্ষার হুমকির বিপরীতে আওয়ামী লীগের কর্মীদের রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণাই বোধ করি এখনকার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বার্তা।
১৪ মার্চ ২০১২
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.