সংবিধানে সামরিক হস্তক্ষেপ

এ দেশে সামরিক সরকারগুলোর সময়ই সংবিধানের ওপর সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে। সংশোধনের নামে সে সময় সংবিধানের মূল চরিত্রই হনন করা হয়েছিল। সংবিধানই বিচার বিভাগকে সংবিধান সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছে। তাই আমাদের বিচার বিভাগ তথা সর্বোচ্চ আদালত সেই গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংবিধানের মূল চরিত্র হননকারী কিছু

সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তবে দেশে যাতে সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি না হয়, সে জন্য অবৈধ সংশোধনীগুলোর কিছু বিষয়কে মার্জনা বা সাময়িকভাবে বহাল রাখার পক্ষেও মত দেওয়া হয়েছে। আদালত একই সঙ্গে জাতীয় সংসদকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আদালতের সে রায় নিয়ে এমন কিছু বক্তব্য বা মতামত পাওয়া যাচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
সামরিক শাসন হচ্ছে বন্দুকের নল থেকে উৎসারিত ক্ষমতার শাসন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। আর তা করতে গিয়ে বাংলাদেশে যেমন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, চিলিতে যেমন প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে, তেমনি পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাই এ শাসনকে পৃথিবীর কোথাও সভ্য শাসন হিসেবে গণ্য করা হয় না। বাংলাদেশেও জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সামরিক সরকারকে করুণ পরিণতি বরণ করে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু নিকৃষ্ট গণতন্ত্রের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতারা সামরিক শাসকদের তোয়াজ করার যে রেওয়াজ তৈরি করেছেন, তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সম্ভবত সে কারণেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ওপর সামরিক শাসকদের অবৈধ হস্তক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করায় তাঁরা খুশি হতে পারেননি। তাঁরা নানাভাবে রায়ের খুঁত বের করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সর্বোচ্চ আদালতের এ রায় জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করার শামিল বলে বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা রায়ের ব্যাকরণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁরা কি সামরিক ফরমানের বলে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করার সময় ব্যাকরণ খুঁজে পেয়েছিলেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে কেউ কেউ স্ববিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। রায়ে অগণতান্ত্রিক এ ধরনের সরকারকে অবৈধ বলা হলেও প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নিকট-অতীতের সংঘাতময় ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান বিবেচনা করে আরো দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমরা কি ২০০৬ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে তার প্রয়োজনীয়তা দেখতে পাইনি? শত চেষ্টার পরও এই দুটি দলের নেতাদের এক টেবিলে বসানো গিয়েছিল? বিরোধী দলের লাগাতার অনুপস্থিতির কারণে জাতীয় সংসদ কি অকার্যকর হয়ে পড়েনি? সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি কি বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পেরেছে? প্রায় তিন দশক কাটাছেঁড়া করা সংবিধান নিয়ে চললেও জাতীয় সংসদ কি তার শুদ্ধতা পুনরুদ্ধারের জন্য বড় কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিল? সংবিধান নিয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শুনে এমনি অনেক প্রশ্ন সামনে এসে যায়। আর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কি বলা হয়নি যে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার জাতীয় সংসদেরই? তার পরও আদালতের রায় বা বিচার বিভাগকে হেয় করার এ ধরনের অপচেষ্টা কেন? বলতে দ্বিধা নেই, এদের কারো কারো বিদেশি প্রভুরা আজকাল এমনটাই চায়। তাদের সেই প্রভুরা গ্লোবালাইজেশনের নামে বিশ্বসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। আর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এসব দেশের সেনাবাহিনীকে তারা কাছে পেতে চায়। তাই তারা সেনাবাহিনীকে 'সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি' হিসেবে উল্লেখ করে আমাদের নতুন নতুন তত্ত্ব গেলানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' অর্জিত বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো কূটকৌশলই কার্যকর হবে না_এটাই আমাদের বিশ্বাস।

No comments

Powered by Blogger.