মত ও মন্তব্য-সংবিধান সংশোধনে দৃঢ় ও যৌক্তিক পদক্ষেপ কাম্য by হারুন হাবীব

১৯৭২ সালের মূল সংবিধান একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও এমন অনেক সংশোধনী আসবে। কাজেই রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন নতুন কিছু নয়। আমাদের দুর্ভাগ্যটা হচ্ছে এই, সামরিক সরকারগুলোর আমলে এই পবিত্র জাতীয় গ্রন্থকে ইচ্ছামাফিক কাটছাঁট করা হয়েছে_এমনকি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের

মূল চেতনা ও আদর্শ থেকেও বিচ্যুত করা হয়েছে। সামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান পাল্টে দেওয়া হয়েছে! জাতির সৌভাগ্য যে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকরী রায়ে ইত্যাকার অসংগতি বাতিল করা হয়েছে। এখন যুগের প্রয়োজনেই আরো কিছু পরিবর্তন বা সংশোধন আনার চিন্তাভাবনা চলছে। জানা গেছে, জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে পরিবর্তনগুলো বিল আকারে আসবে। সাম্প্রতিককালে বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা সংবিধান সংশোধনীর বিষয় নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ করে চলেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ বিতর্ক বেশ জায়গা করে নিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক সহযোগীরা, যারা আবার প্রায় প্রকাশ্যেই মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতির প্রবক্তা, এমনকি দেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও ইতিহাসেরও ঘোরতর বিরোধী, তারা বলে চলেছে, এ সরকারের সংবিধান পরিবর্তনের কোনো অধিকার নেই। এটিও বলছে, সাংবিধানিক কোনো পরিবর্তন আনতে হলে আগে দেশের মানুষের মতামত চাই, গণভোট বা রেফারেন্ডাম চাই।
আমার সত্যি সত্যি জানার ইচ্ছা করে, বাংলাদেশের সংবিধান আগে যতবার (সম্ভবত ১৩ বার) পরিবর্তন করা হয়েছে একটিবারও কি দেশে গণভোট হয়েছিল? যাঁরা আজ এ দাবি তুলছেন, তাঁরাও কি গণভোট করেছিলেন, নাকি তার কথা চিন্তা করেছিলেন? না, করেননি। কাজেই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে গণভোটের কথা তুলে মূলত সাংবিধানিক সংশোধনীর গুরুত্বপূর্ণ ও অতিপ্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াটিকেই শ্লথ বা ভণ্ডুল করার চক্রান্ত হচ্ছে কি না। বর্তমান প্রক্রিয়ার অধীনে বাংলাদেশে নতুন কোনো সংবিধান রচিত হচ্ছে না। বিদ্যমান সংবিধানের কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংশোধনী আনার চিন্তা হচ্ছে মাত্র। এ লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটিও কাজ করে চলেছে, যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও সে কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল এখন পর্যন্ত যোগ দেয়নি। দিলে সাংবিধানিক এ পরিবর্তন নিঃসন্দেহেই আরো সমঝোতাপূর্ণ হতে পারত এবং পরিপূর্ণতা লাভ করত। কমিটি সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের মতামত নিয়েছে। অন্য সবাই যোগ দিলেও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বা বিএনপির কোনো প্রতিনিধি গুরুত্বপূর্ণ এ মতবিনিময়ে যোগ দেননি। আমরা আশা করব, প্রধান বিরোধী দল যেন এ প্রক্রিয়ায় আসে সে চেষ্টা সংসদীয় কমিটি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবে।
বলা বাহুল্য, এ ধরনের মতামত গ্রহণ একটি শুভ উদ্যোগ_যা আগে কখনো ঘটেনি। কারণ শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে সংবিধানের মতো পবিত্র গ্রন্থকে ইচ্ছামাফিক পরিবর্তন করা উচিত নয়। এ কথাটিও বলা সংগত হবে যে আলোচনার যে প্রক্রিয়া বর্তমান শাসক দল বা জোটের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে তা প্রশংসনীয়। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত এ ক্ষেত্রে অতি জরুরি। সংবিধান রচনাকালের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক হিসেবেই কেবল নয়, পরবর্তীকালের প্রায় প্রতিটি পরিবর্তনের ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করার সুবাদেই জানি, কিভাবে শাসকদের ইচ্ছামাফিক, পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো রাতারাতি সংবিধান পরিবর্তনের বিল এনে তা পাস করিয়েছে। কাজেই কাউকে ন্যায্য-অন্যায্য শেখানোর আগে নিজেদের অতীত কর্মকাণ্ড ভেবে দেখা উচিত। যেকোনো দেশে সংবিধান পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্য রীতি আছে। আমাদের পদ্ধতিতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি লাভ করলেই সংবিধান পরিবর্তন কেবল কার্যকর হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন আছে কি না_সেটিই দেখার মূল বিষয়। এর পরও বলব, সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক গ্রন্থ; কাজেই এর পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের বিষয়টিকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা উচিত নয়। অতীতের কদর্য দৃষ্টান্তগুলোকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে, গণতান্ত্রিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে।
সরকারবিরোধী নানা বলয় থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধান সংশোধন করতে হলে আগে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত নিতে হবে। এ দাবি নিশ্চয়ই অগ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংবিধান পরিবর্তন কোনো ছেলেখেলা নয়, এটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক গ্রন্থের প্রশ্ন। দেশের মানুষের মতামত এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন বৈকি। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের মানুষের মতামত গ্রহণের পদ্ধতিটা কী? পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের মতামত গ্রহণের পদ্ধটি বিধৃত আছে, আছে আমাদের দেশেও। এটি নতুন কোনো আবিষ্কারের বিষয় নয়। জাতীয় সংসদ গঠিত হয় দেশের সাধারণ মানুষের ভোটে। যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন লাভ করে তারাই সরকার গঠন করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটে জাতীয় সংসদের মতামতের মধ্য দিয়ে। এটি স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতি। কাজেই সাংবিধানিক রীতিতেই সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যখন একযোগে কোনো পরিবর্তনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করবেন, তখনই ধরে নিতে হবে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় যাঁরা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান, আমার সন্দেহ হয়, তাঁরা জেনেশুনেই বিতর্কের বেড়াজালে প্রক্রিয়াটিকে বানচাল করার চিন্তা করছেন কি না। সাংবিধানিক সংশোধনী নিয়ে সাম্প্রতিককালের বিবৃতি ও বিতর্কগুলো পর্যালোচনা করে জানা যায়, আগামী অধিবেশনে যে পরিবর্তনগুলো আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, একই সঙ্গে জাতীয় গৌরব পুনরুদ্ধারের। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যুক্ত করে সংশোধনী বিলটি উত্থাপনের চিন্তা চলছে। যেকোনো আধুনিকতা-মনস্ক মানুষের কাছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী জনগোষ্ঠীর কাছে এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।
সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, কমিটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতেও কিছু বিষয় যুক্ত করতে একমত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনেও এ পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে কেউ যদি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত, বাতিল বা কোনো অনুচ্ছেদ রদ করেন, তাহলে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হবেন_এমন বিধান রাখারও চিন্তা চলছে। অতীত অপকর্মের অভিজ্ঞতায় এমন বিধান সংযোজন অবশ্যই জরুরি কাজ। বাস্তবে কতটা কী হবে জানি না, তবে অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক শাস্তির বিধি নির্ধারিত থাকলে জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। আরো যে বিষয়টি জরুরি তা হচ্ছে, চলতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটিকে আরো বেশি কার্যকর করা; যাতে অনির্বাচিতরা নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে ক্ষমতায় থাকতে না পারেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন। সাম্প্রতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ক্ষমতার সময়সীমা যেভাবে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করার যে চেষ্টা হয়েছে_তাতে চলতি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সংশোধন অবশ্যই প্রয়োজন বলে মনে করি। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে_যাতে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে।
বিতর্ক যাই থাক, সাংবিধানিক বিলটি কিভাবে আনা হয় তা দেখতেই দেশবাসীর এখন আগ্রহ বেশি। ১৯৭২-এর সংবিধান হুবহু প্রতিস্থাপিত হবে নাকি কিছু ক্ষেত্রে 'বাস্তবতার নিরিখে' কিছু পরিবর্তন আসবে_সেটিও দেখার বিষয়। আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, মুক্তিযোদ্ধারা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রাণ দিয়েছিলেন। এ মৌলিক নীতিগুলোর পরিবর্তন আনা হয়েছিল সামরিক ফরমানের আগ্রাসনে; যা ছিল পরিপূর্ণ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা। সুখের বিষয়, সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'স্বাধীনতার ঘোষণা' বা 'প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স' যুক্ত করার বিষয়েও বিশেষ কমিটি একমত হওয়ার ফলে আরো একটি বড় কাজ সম্পাদিত হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। যে ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল সামরিক ফরমানে। জানতে পেরেছি, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি বাহাত্তরের সংবিধানের মতোই পুনঃস্থাপিত করা হবে। তবে বলতেই হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিংবা ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকা কতটা বিবেচনাপ্রসূত হবে_তার উত্তর অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের খুঁজতে হবে। কারণ সাময়িক সুবিধার্থে এমন কাজ করা উচিত হবে না, যাতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধীরা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে যারা রাজনীতি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে_তারা উপকৃত হয়।
মোদ্দা কথা, সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বাহাত্তরের সংবিধানকেই পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা হচ্ছে_যা একটি জরুরি জাতীয় কাজ। এখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের, অনৈতিক সমঝোতার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। সংসদীয় বিশেষ কমিটিকে যে কথাটি বলতে চাই_বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে না যাওয়া এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে স্বীকৃতি না দেওয়ার গোষ্ঠী, মৌলবাদী-জঙ্গিরা এবং অসাংবিধানিক শাসনের সমর্থকরা কখনো রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর পুনরুদ্ধার চাইতে পারে না। কাজেই নানা ফন্দি-ফিকির তারা করতেই চাইবে_যাতে বর্তমান জাতীয় সংসদ তাদের প্রার্থিত কাজটি সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়। কাজেই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সাহস, যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে সুমহান কাজটি সম্পাদন করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা সম্পাদন করতে হবে। অন্যথায় বিরুদ্ধবাদীরা পরিস্থিতি ঘোলা করতে আগের চেয়েও সক্রিয় হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.