বায়জু নারাভান-এক মেধাবী কর্মজীবনের অবসান

গত শনিবার নিউ ইয়র্কে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) প্রধান দমিনিক স্ত্রস-কানের ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনা ফ্রান্সে বোমা বিস্ফোরণের মতো আলোড়ন তুলেছে। কথা ছিল, দমিনিক কান আইএমএফ প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ এবং ২০১২ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

কিন্তু তাঁর গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদের ক্যারিয়ারের অবসান ঘটল। ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি মার্তিন অব্রে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, 'আমি স্তম্ভিত! এ সংবাদ যেন আকাশ থেকে বজ্রপাতের মতো এসেছে।'
দমিনিক কানের গ্রেপ্তারের ঘটনা সোশ্যালিস্ট পার্টির জন্য চরম হতাশাজনক হলেও ফ্রান্সের ডানপন্থীরা আনন্দে হাতে তুড়ি দিচ্ছেন। শাসক ইউএমপি (ইউনিয়ন ফর এ পপুলার মুভমেন্ট; ফরাসি ভাষায় ইউনিয়ন পো উন মুফমেন্ত পপুলেয়ার_অনুবাদক) দলের পার্লামেন্ট সদস্য বার্নার্দ দেব্রে কানের পতন সম্পর্কে কোনো অস্বস্তি দেখালেন না। প্রখ্যাত সার্জন ড. দেব্রের মতে, 'কান কোনো সম্মানীয় ব্যক্তি নন। তাঁর মনে যৌনতা রয়েছে। এ ঘটনা ফ্রান্সের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে।'
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রস নির্দোষ। চরম ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মেরিন লি পেন বলেছেন, 'স্ত্রস ফ্রান্সের জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন।'
স্ত্রস-কানের এই সংকট ফ্রান্সের ডান এবং চরম ডানপন্থীদের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। কখনোই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট সারকোজির অবস্থান এত নিচু অবস্থানে ছিল না; এবং কখনোই চরম ডান, অভিবাসনবিরোধী এবং ইসলামবিরোধীরা এত উঁচু অবস্থানে উঠতে পারেনি। দমিনিক স্ত্রস-কান একমাত্র নেতা, যিনি মধ্য-ডানদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
তাঁর ভাবমূর্তিটা এমন ছিল যে, তিনি হলেন বাজারবান্ধব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট; এবং ফ্রান্সের বামদের একটি বড় অংশের পাশাপাশি মধ্যপন্থী নিকোলাস সারকোজির ভোট কেড়ে নিতে পারেন। তাঁর এই হঠাৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান সোশ্যালিস্টদের একটা সংকটের মধ্যে ফেলে দিল, যেখানে বেশ কিছুসংখ্যক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তাঁর জায়গাটা পূরণ করার প্রয়াস পাবে, যাঁদের কারোই বিশেষ ক্যারিশমা নেই। স্ত্রস যে দক্ষতা ও মেধা দেখিয়েছেন, তা তাঁদের নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে স্ত্রসের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা, ফ্রান্সের ডানপন্থী প্রচারমাধ্যম বারবার তাঁর জীবনযাপনের ধরন সম্পর্কে আক্রমণ করার চেষ্টা চালিয়েছে। দর্জির কাছে তাঁর একটি স্যুট তৈরি হয় ৩২ হাজার ডলারে। তাঁর রয়েছে মরক্কোর মারাকেসে বিলাসবহুল ভিলা। প্যারিসে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন নগদ চার মিলিয়ন ডলার দিয়ে। ওয়াশিংটনে রয়েছে আকর্ষণীয় পাঁচ বেডরুমের বাড়ি। কিন্তু এসব সম্পদের অধিকাংশই এসেছে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী আনে নিক্লেয়ারের পক্ষ থেকে।
ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ট পার্টিই শুধু একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, যারা নিজেদের একটি সংকটের মধ্যে দেখছে; সবার মুখে মুখে এখন একটি প্রশ্ন_এরপর আইএমএফের প্রধান কে হবেন? স্ত্রস-কান যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
স্ত্রস-কান আইএমএফকে ধীরে ধীরে উঠে আসা (ইমার্জিং) অর্থনীতির জন্য মুক্ত করতে শুরু করেছিলেন। তিনি আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে ইউরোপ-আমেরিকার পুরোপুরি প্রভাবের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বব্যাংকের প্রধান হন আমেরিকান এবং আইএমএফের প্রধান হন ইউরোপিয়ান। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডের এই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির পর থেকে স্ত্রস-কান হলেন চতুর্থ ফরাসি নাগরিক, যিনি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। স্ত্রস-কানকে মূল্যায়িত করতে গিয়ে দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিল : তিনি যখন ২০০৭ সালের শরতে এলেন, তখন তিনটি বড় সমস্যায় ভুগছিল ফান্ড। আদর্শগতভাবে এটি ছিল মুক্তবাজার দর্শনের কাছে, যা বিশ্বব্যাংকিংকে তলে তলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এটা দুর্বল নেতৃত্বে ভুগছিল এবং এর অর্থসংকট ছিল।
কান তাঁর কর্মে আর ফিরে আসবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর অনুপস্থিতিতে ফান্ড দ্বিতীয় ব্যক্তি জন লিপস্কি আসন্ন মিটিংগুলোর দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু আগামী আগস্ট মাসে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে মনে হচ্ছে। তবে তিনি নভেম্বরে জি-২০ মিটিং পর্যন্ত বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে থাকতে সম্মতি জানিয়েছেন।
বেশ কয়েকজন উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী ইউরোপে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনও। কিন্তু তাঁর প্রার্থিতা নস্যাৎ হতে পারে আর কারো দ্বারা নয়, খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা, যিনি খোলাখুলিভাবে বলেছেন, পরবর্তী আইএমএফপ্রধান হওয়া উচিত ভারত, চীন অথবা দক্ষিণ এশিয়া থেকে কারো। কারণ, সংগঠনটির এমন কাউকে প্রয়োজন, যিনি অতিরিক্ত ব্যয়ের বিপদ বোঝেন।
একজন অবশ্য স্ত্রস-কানের পরবর্তী হিসেবে যোগ্য হতে পারেন। তিনি হলেন মনটেক সিং আহলুয়ালিয়া। অন্য যাঁদের নাম আছে, তাঁরা হলেন মিসরের কূটনীতিকের সন্তান, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মেদ এ এল এরিয়ান। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং প্রিমকোর বন্ড বিনিয়োগকারী। আর রয়েছেন ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক প্রধান আরমেনিও ফ্রাগা এবং মেঙ্েিকার সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক প্রধান গিলেরমো ওরতিজ।
দ্য হিন্দু থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.