চারদিক-মেঘে ঢাকা তারা by আসিফ সালেহ

গ্রামের পাড়ার মধ্যে একটি ছোট ঘর, সেখানে আছে কিছু বই, কিছু খেলার সরঞ্জাম আর নাচ-গানের কিছু উপকরণ। এই সবকিছুর পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষার আয়োজন তো আছেই। এটি হচ্ছে কিশোরী ক্লাব। সারা দেশে এমন ক্লাবের সংখ্যা সাড়ে আট হাজারের মতো।


মাস চারেক আগে যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছে, তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়া সিএনএনে একটি খবরে দেখি, এসব ক্লাবের মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে। বাহ! বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, তা-ও আবার পাড়াগাঁয়ের সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা? আমার কৌতূহল দানা বাঁধে এই ক্লাব নিয়ে।
কিছুদিন পর পারভিন আপা (রাশিদা পারভিন) আসেন আমার কাছে। তিনি ব্র্যাকের কিশোরী উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নামের এই প্রকল্পকে ছায়ার মতো আগলে বড় করেছেন। তবে তিনি কথা বলেন আরেকটি নতুন কর্মসূচি নিয়ে। তা হলো, কিশোরী ক্লাবের সদস্যদের অংশগ্রহণে সংগীত ও নৃত্য প্রতিযোগিতা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় দুই লাখ ৬০ হাজার কিশোরী অংশ নেয়। ক্লাব পর্যায় থেকে শুরু হয়ে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় শেষে জাতীয় পর্যায়ে টেলিভিশনে অংশ নেয় ৩২ জন কিশোরী। নাচ-গানের এই রিয়েলিটি শোর নাম ‘মেঘে ঢাকা তারা’। তিনি বলেন, ‘এত দিন ধরে আমরা যা করছি, এখন একটু জানুক দেশের লোক। দেখুক, সুযোগ পেলে আমাদের সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা কত কী করতে পারে। তাই এই শোর আয়োজন।’
তারপর তিন মাস কেটে গেছে। প্রতি শুক্রবার রাত আটটায় এটিএন বাংলায় এশিয়াটিকের প্রযোজনায় ব্র্যাক ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশবাসীর অনেকে দেখেছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ অনুষ্ঠানটি। আর এর রেডিও সহযোগী হিসেবে ছিল ‘এবিসি’। গত ২২ জুন ছিল এর চূড়ান্ত পর্ব। আমরা সবাই হাজির হই ঢাকার ইস্কাটনের বিয়াম অডিটোরিয়ামে। পরের এক ঘণ্টা আমাদের মনকে উদ্বেলিত করে তোলে ৩২ জন মেয়ের মধ্যে বাছাই হওয়া ছয়জন। জামালপুরের লিমা, টাঙ্গাইলের মিতু সুযোগ পেয়ে এত অল্প সময়ে এত সুন্দর নাচ ও গান রপ্ত করেছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। আজ ১ জুলাই রাত আটটায় এটিএন বাংলায় দেখা যাবে পুরো অনুষ্ঠানটি। সাড়ে আট হাজার ক্লাবের দুই লাখ ষাট হাজার কিশোরীর মধ্যে অল্পসংখ্যককেই বাছাই করা গেছে। কিন্তু সবাই নাচ-গান-অভিনয়-ক্রিকেট পারুক আর না-পারুক, ওরা আমাদের অতি আদরের ও গর্বের।
কাজের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই যেতে হয় ঢাকার বাইরে। সুযোগ পেলেই ঘুরে আসার চেষ্টা করি স্থানীয় কিশোরী ক্লাব। তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এমনই একটি কিশোরী ক্লাবে কথাবার্তা বলে বের হওয়ার পর একজন কিশোরের দেখা পেলাম। তার অনেক উৎসাহ, সে উপন্যাস লিখেছে। অনুরোধ করতেই দুর্দান্ত একটি অভিনয় করে দেখিয়ে দিল। তারপর দেখলাম কিশোরীদের পরিবেশিত চা-বাগানের ঐতিহ্যবাহী নাচ। তাদের অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যখন ফিরছি, তখন সেই ঔপন্যাসিক কিশোর পথ আটকাল, ‘এবার কিশোরদের জন্য কিছু করেন, ভাইয়া—কিশোরীদের জন্য তো অনেক হইল।’
আসলেই কি তাই? ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সুরেই বলতে হয়, দারিদ্র্য দূর করার কোনো ম্যাজিক সমাধান নেই। কিন্তু আছে একটি মোক্ষম অস্ত্র। সেটি হলো মেয়েদের শক্তিশালী করা। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনি সহায়তা আর সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস দিয়ে বলীয়ান করতে পারলে আমাদের প্রথম অর্ধেক বিজয় সম্পন্ন হবে। মেয়েদের এই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তোলাই কিশোরী ক্লাবের লক্ষ্য। দেশে এখনো বাল্যবিবাহের হার আশঙ্কাজনক। সরকারি হিসাবেই ৬৯ শতাংশ। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এসব কিশোরী বাল্যবিবাহে বাধা দেবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে—সেই উদ্দেশ্যেই তাদের কঠিন জীবনে এই বৈচিত্র্যের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার চেষ্টা।
দুই দিন আগে রংপুরের ব্র্যাক জেলা প্রতিনিধি একটি চিঠি পাঠালেন। সরকারি প্রশিক্ষক নির্বাচনে তিনি ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। সেখানে এক নারী তাঁর আত্মবিশ্বাসী উত্তরের মাধ্যমে সবার নজর কাড়েন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি কোথায় এসব শিখলেন?’ এতে তাঁর উত্তর ছিল, ‘আমি কিশোরী ক্লাবের সভানেত্রী ছিলাম।’ এরপর প্রশ্নকর্তা তাঁকে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। ওই নারী চাকরি পেয়ে যান। এমনি ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমেই নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশে এখন অনেক দূর এগিয়ে চলেছে। কিন্তু রুমানা মনজুর আমাদের মনে করিয়ে দেন, এখনো অনেক পথ চলা বাকি। আশা করি, মেঘে ঢাকা কোটি কোটি তারা মুক্ত আকাশে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে ভাঙবে এই অচলায়তন।
আসিফ সালেহ
পরিচালক, ব্র্যাক কমিউনিকেশনস

No comments

Powered by Blogger.