আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১২-নারীনীতি বাস্তবায়ন আর কবে by শরীফা বুলবুল

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা গত বছর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন করা হলেও এর বাস্তবায়ন ঢিলাভাবে চলছে- এমন মন্তব্য করে দেশের নারী নেত্রীরা বলেছেন, নীতি গৃহীত হলেও সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য হৃদয়ঙ্গম করা হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক। এর বাস্তবায়ন আপাতত হবে বলে মনে হয় না।


সাংবিধানিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য এবং কাঠামোগত দিকনির্দেশনা নিয়ে নারীনীতির দ্রুত বাস্তবায়ন দাবি করেছেন তাঁরা।
নারী নেত্রী সালমা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার গত বছর জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুমোদন করে নারী দিবসে নারীদের আশান্বিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু একটি বছর চলে গেলেও মূল্যায়ন করার মতো তেমন কিছু দেখলাম না। লক্ষ্য এবং কর্মকৌশল নির্ধারণ করে সংবিধানের আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে নীতিমালাটি আইনে পরিণত করা দরকার। কারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নারী যখন আদালতে যাবেন, তখন নীতিমালা গুরুত্ব পাবে না। পূর্ববর্তী আইন কী বলে, সেটাই গুরুত্ব পাবে। তিনি আরো বলেন, 'সংবিধানে নারীকে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারীনীতিতে প্রকৃত অর্থেই সেই সমতা জরুরি। এই নীতিমালায় সেটার প্রতিফলন থাকলেও বাস্তবায়নে তেমন আশার আলো দেখছি না।'
অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারী নীতি অনুমোদনের পর এর কর্মপরিকল্পনা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত ছিল। বর্তমান সরকারের মেয়াদও প্রায় শেষের দিকে, সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বল্পকালীন, মধ্যকালীন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান অব অ্যাকশন থাকা দরকার ছিল। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি নিয়ে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু বলেন, 'নারী নীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকেই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান করে কর্মপরিকল্পনার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ এমনটি হওয়া উচিত নয়। আমরা আশা করছি, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন ঘটবে এবং অনতিবিলম্বে এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে।'
নারী উন্নয়ন নীতি ধীরগতিতে চলছে- এমন মন্তব্যের বিরোধীতা করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা অযৌক্তিক কথা। নারী নীতির ব্যাপারে সবারই একমত পোষণ করা উচিত। ১০টিরও বেশি মন্ত্রণালয়ে নারীবান্ধব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নারী নীতি বাস্তবায়নে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিরও পরিবর্তন হয়। এতে নারী উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পসহ সব ধরনের কাজ ঝুলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় বাতিল ও অন্তর্ভুক্তিকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা বিভ্রান্তি। যখন যে সরকারই আসুক, এর ওপর হস্তক্ষেপ করা নীতিটির জন্য মঙ্গলজনক নয়।'
নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে উত্তরাধিকার বিষয়ে নারীকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অধিকার দেওয়া হয়েছে। নীতির অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ধারায় বলা হয়েছে, 'স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা, উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।'
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালার সংশোধনী এনে ২০০৪ সালে নতুন করে নীতিমালা ঘোষণা করে। ওই নীতিমালায় 'উত্তরাধিকার সম্পদ' কথাটি বাদ দেওয়া হয়। পরে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৭ ও ২০০৪ সালের নীতিমালার আলোকে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ ঘোষণা করে। সেই নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে 'উত্তরাধিকার' শব্দটি বাদ দিয়ে 'স্থাবর ও অস্থাবর' শব্দ যোগ করা হয়। এতে বলা হয়, 'নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরি বিষয়াদি যথা- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, তথ্য উপার্জনের সুযোগ, সম্পদ, ঋণ, প্রযুক্তি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ; নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করা।'
নারীর অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল। ইশতেহারের রূপকল্প অংশে বলা হয়, 'রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে নারীর সমান অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের নারী নীতি পুনর্বহাল ও কার্যকর করা হবে, বৈষম্যমূলক আইনসমূহের সংস্কার করা হবে এবং সংসদে প্রত্যক্ষ ভোটে নারীর জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হবে।
নতুন নারী নীতিমালায় দুর্যোগকালে নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা রয়েছে। নারী নীতিতে বলা হয়েছে, 'দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসনের সময় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীর নিরাপত্তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে।'
এ ছাড়া প্রথমবারের মতো কৃষিতে নিয়োজিত নারীর শ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নতুন নারী নীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকদের সব ধরনের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাদের শ্রমের মজুরি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিভেদ দূর করারও উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কৃষি উপকরণ, সার, বীজ, কৃষক কার্ড, ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সমান সুযোগ দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ঘোষণা রয়েছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অংশে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর নারীর উন্নয়নের বিষয়টিও এই নীতিতে রয়েছে।
'কিশোরী, তরুণী বালিকা মিলাও হাত'

No comments

Powered by Blogger.