স্মরণ-সোমেন চন্দ : তাঁর চেতনার মশাল অনির্বাণ by কাজী জাকির হোসেন

১৯৪২ সালের ৮ মার্চ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার হৃষিকেশ দাস লেন মোড়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন সোমেন চন্দ। তাঁর হত্যার বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে তিনি প্রগতিশীল সাহিত্য রচনার অন্যতম পথিকৃৎ। শক্তিমান প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক।


বাংলার প্রথম শহীদ সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠক। মাত্র ২১ বছর ৯ মাস ১৫ দিন তিনি বেঁচেছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিচিত্র কাজের এক অনুকরণীয় সম্ভার গড়ে তোলেন। পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশুণ্ডীতে তিনি প্রগতি পাঠাগার গড়ে তোলেন। ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ গঠন ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এ সংগঠনের তিনি সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী প্রমুখ সাহিত্যিকবৃন্দ। পূর্ব বাংলা রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সোমেন চন্দ বাংলা সাহিত্যে পরীক্ষামূলক প্রগতিশীল রচনা সৃজনে ছিলেন অনন্য। মাত্র পাঁচ বছরে (১৯৩৭-১৯৪২) শ্রমিক আন্দোলনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেই তিনি ২৮টি গল্প, দুটি উপন্যাস, যার একটি উদ্ধার হয়নি, দুটি নাটক ও বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেন। বাংলা ছোটগল্পে তিনি অতুলনীয় সাহিত্য-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। দাঙ্গা, ইঁদুর, সংকেত, বনস্পতি ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গল্প। এগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ইঁদুর গল্পটিকে বিশ্বের সেরা একটি গল্প বলা হয়। অশোক মিত্র (আইসিএস) Mice নামে এটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। অন্নদাশঙ্কর রায়, হীরেন মুখার্জিও গল্পটির ইংরেজি ভাষান্তর করেন। খাজা আহমদ আব্বাস সম্পাদিত ওয়ার্ল্ড শর্ট স্টোরিজ সংকলনে এটি স্থান পায়। বিশ্বের অন্যান্য ভাষায়ও এ গল্পটি অনূদিত হয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায় 'সংকেত' গল্পটিকে Sign নামে অনুবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে এ গল্পটিকে সৃজনী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীর লেখক প্রয়াত সোলায়মান ও মোজাম্মেল হোসেন মন্টু যৌথভাবে নাট্যরূপ দেন। সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় আবুল হায়াৎ, ইনামুল হক, লায়লা হাসান, সোলায়মান প্রমুখের অভিনয়ে নাটকটি বাংলা একাডেমী ও পল্টন ময়দানে মঞ্চস্থ হয়। সোমেন চন্দের 'দাঙ্গা' গল্পটিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার প্রথম গল্প বলা হয়। তাঁর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ প্রতিবাদী কবিতা লেখেন। কবি বুদ্ধদেব বসু সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে 'প্রতিবাদ' শীর্ষক যে কবিতাটি লেখেন, তাকে কবির জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৮৭ সালে হায়াৎ মামুদের রচনায় সোমেন চন্দের জীবনী প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। সোমেন চন্দের রচনাবলি বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় বের করে বাংলা একাডেমী। বাংলা একাডেমীর একুশে সংকলনের তৃতীয় উপন্যাসটি লেখেন 'নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি' নামে সেলিনা হোসেন। এখানে সোমেন চন্দ ও মুনীর চৌধুরীর জীবনকাহিনী শিল্পরূপ পেয়েছে। ১৯২০ সালের ২৪ মে ঢাকার আশুলিয়ায় মা হিরণবালার গর্ভে সোমেনের জন্ম। বাবা নরেন্দ্র চন্দ। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার বর্তমান পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামে। পুরান তাঁতিবাজার, ঠাঁটারীবাজার এবং দক্ষিণ মৈশুণ্ডীতে সোমেন পরিবার বসবাস করত। ১৯৩৬ সালে সদরঘাটের পগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। পরে বাবার কর্মস্থল মিটফোর্ড হাসপাতাল স্কুলে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক এবং শারীরিক কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেন। মনোযোগ দেন সাহিত্যচর্চা আর রাজনীতিতে।
কাজী জাকির হোসেন

No comments

Powered by Blogger.