কলকাতার চিঠি-পশ্চিমবঙ্গে দ্বিকক্ষ আইনসভা হচ্ছে? by অমর সাহা

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে তিনি সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেবেন, দার্জিলিং সমস্যার সমাধান করবেন এবং পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা বা বিধানসভা দুই কক্ষে গড়বেন।


মমতা তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই দার্জিলিং গোর্খা জনমুক্তি নেতা বিমল গুরুংসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করে দার্জিলিং সমস্যার সমাধানকল্পে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছেন। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বিধানসভায় পাস করে জমি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যদিও সিঙ্গুরের জমি নিয়ে ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছে টাটাগোষ্ঠী। সেই মামলা এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। অন্যদিকে, রাজ্য সরকার অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার জন্য গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করেছে জমি জরিপের কাজ। মঙ্গলবারই মাপজোখ করে ১২ কৃষকের জমি চিহ্নিত করে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পাদিত চুক্তি ভারতের সংবিধানসম্মত কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আইন মন্ত্রকের পরামর্শ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা, যাকে বলা হয় রাজ্য বিধানসভা, তা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন মমতা। বিধানসভার পাশাপাশি গঠন করা হচ্ছে বিধান পরিষদ। এটি হবে রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ আর বিধানসভা হবে নিম্নকক্ষ, যেমনটা কেন্দ্রে রয়েছে আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভা। মঙ্গলবার রাজ্য বিধান পরিষদ গড়ার লক্ষ্যে রাজ্য বিধানসভায় একটি প্রস্তাবও পেশ করেন বিধানসভার উপনেতা এবং শিল্প ও পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিরোধী বামফ্রন্ট এবং তৃণমূলের শরিক এসইউসিআই। তারা দাবি করে, এখন বিধান পরিষদ গঠনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব অযৌক্তিক, ব্যয়বহুল এবং শ্বেতহস্তী পোষার শামিল। ৪১ বছর আগে সাবেক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারই বিধান পরিষদ বাতিল করে দিয়েছিল। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল যুক্তফ্রন্ট, আর বিধান পরিষদে গরিষ্ঠ ছিল কংগ্রেস। বিধান পরিষদের আসন ছিল ৭৫। সেই ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে বিধান পরিষদ বাতিল হয়। তখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার আসন ছিল ২৮০, এখন ২৯৪। ২৮০ সদস্যের মধ্যে ২২২ জন সদস্য বিধান পরিষদ বাতিল করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। পরে বিধান পরিষদ অবলুপ্তির বিল লোকসভা, রাজ্যসভা এবং সবশেষে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়েছিল। সেদিন বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও ওই বিধান পরিষদ বাতিল করার পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন। পরে বাতিল হয়ে যায় বিধান পরিষদ।
মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধান পরিষদ গড়ার প্রস্তাব উঠলে আপত্তি তোলে বামফ্রন্ট এবং তৃণমূলের শরিক জোট এসইউসিআই। এ সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলের দাবিকে সম্মান জানিয়ে বলছি, প্রস্তাবটি খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হোক।’ পরে বিধানসভায় বিরোধী দলের আপত্তির মুখে বিধানসভার স্পিকার এই লক্ষ্যে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার ঘোষণা দেন। এই কমিটি ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে রাজ্য বিধানসভায় প্রতিবেদন দেবে। যদিও বর্তমান বিধানসভায় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মোট আসনসংখ্যা ২২৭, দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। সুতরাং মমতা চাইবেন তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার। আর তিনি এটা করতে পারবেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। যদিও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ গড়ার ব্যাপারে কোনো আইনি সমস্যা নেই।
ভারতে রয়েছে এখন ২৮টি রাজ্য এবং সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। ২৮টি রাজ্যের মধ্যে এখন ছয়টি রাজ্যে রয়েছে বিধান পরিষদ। এই রাজ্যগুলো হলো: উত্তর প্রদেশ, বিহার, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ এবং জন্মু ও কাশ্মীর। বিধান পরিষদ কোনো আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখে না। এই পরিষদ কেবল প্রস্তাব আনতে পারবে, পরামর্শ দিতে পারবে। আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা থাকবে বিধানসভার। বিধানসভার স্পিকারের মতো কোনো পদ থাকবে না বিধান পরিষদে। থাকবে রাজ্যসভার মতো চেয়ারম্যান এবং ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদ। বিধান পরিষদের সদস্য বিধানসভার মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গে সেই হিসাবে ৯৪ আসনের বিধান পরিষদ হতে পারে। বিধান পরিষদের সদস্য করা হবে পৌরসভা, পৌর করপোরেশন, জেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সরকার সংস্থার সদস্য, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশিষ্টজন, রাজ্য বিধানসভার সদস্য এবং রাজ্যপালের মনোনীত রাজ্যের বিশিষ্টজনকে। তাঁরা নির্বাচিত হবেন পরোক্ষ ভোটে। রাজ্যপাল মোট সদস্যের এক-ষষ্ঠাংশ প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে পারবেন। বিধান পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৪০-এর নিচে হতে পারবে না। যদিও বিশেষ আইনবলে জন্মু ও কাশ্মীরের বিধান পরিষদের সদস্যসংখ্যা ৩৬ করা হয়েছে। বিধান পরিষদ হবে ছয় বছর মেয়াদি। এটি হবে স্থায়ী একটি পরিষদ।
মমতা চাইছেন বিধান পরিষদ গঠন করে রাজ্যের আরও বেশ কিছু বিশিষ্টজন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঠাঁই দিতে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বামদল এবং এসইউসিআই। সমর্থন জানিয়েছে কংগ্রেস এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। বিধান পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে রাজ্যের মন্ত্রী করারও বিধান রয়েছে। যাঁরা নির্বাচন করে বিধানসভায় আসতে পারেননি, অথচ তাঁরা বিধান পরিষদের সদস্য হয়ে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন। তাই বাম দল বলেছে, কেন আবার ৪১ বছর পর বিধান পরিষদ গঠনের উদ্যোগ? এটা তো খরচ বাড়ানোর আরেকটি পন্থা। যেখানে বিধানসভার সিদ্ধান্তই শেষ কথা, সেখানে বিধান পরিষদ অর্থহীন। এটি গঠন করা হলে প্রয়োজন হবে আলাদা একটি অধিবেশনকক্ষ, চেয়ারম্যান, ডেপুটি চেয়ারম্যানের কক্ষসহ সদস্যদের থাকার হোস্টেলও। তাই বাড়তি খরচ কমানোর জন্যই দাবি তুলেছে বিরোধীরা।
তবে শেষ পর্যন্ত মমতা বিরোধীদের দাবি মানবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ মমতা যা বলেন, তা করার চেষ্টা করেন।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.