কিডনি সংযোজনে আইনি জটিলতা দূর হোক by এমএ সামাদ

বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ বেড়েই চলেছে। কিডনি রোগের ভয়াবহ পরিণতি ঠেকাতে মানুষকে সচেতন করতে প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস উদযাপন করা হয়। এবার পালিত হচ্ছে সপ্তম বিশ্ব কিডনি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, 'জীবন বাঁচাতে কিডনি দান করুন।


' কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হওয়ার পরে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। একজন কিডনি রোগীর এক বছরেই ওষুধসহ ডায়ালাইসিসের খরচ ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা। ডায়ালাইসিসের খরচ বেশি হওয়ার কারণে এ দেশের শতকরা ১০ জন রোগীও এই দীর্ঘ মেয়াদি ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অন্যদিকে কিডনি সংযোজন কিডনি বিকল রোগীর সর্বোত্তম চিকিৎসা। প্রথম সফল কিডনি সংযোজন হয় ১৯৫৪ সালে। ১৯৬২ সালে মৃত ব্যক্তি থেকে কিডনি সংগ্রহ করে সংযোজন করা হয়। এরপর থেকে কিডনি সংযোজন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বিশ্বব্যাপী কিডনি বেচাকেনার অশুভ ব্যবসায়ী দালালচক্র গড়ে ওঠে। মানুষের অঙ্গ নিয়ে অমানবিক ব্যবসা রোধ করতে বিভিন্ন দেশে তখন অঙ্গ সংযোজন আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশেও মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী রক্তসম্পর্কীয় স্বজন ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অঙ্গ লেনদেন বৈধ। এর বাইরে কেউ স্বেচ্ছায় দান করতে চাইলেও কিডনি দেওয়া বা নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তি বা ইৎধরহ ফবধঃয হয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির কিডনি নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া বর্তমান আইনে সম্পর্ক নির্ণয়ের সুস্পষ্ট কোনো বিধান না থাকায় অনেকেই কাগুজে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়ে আসে। সে ক্ষেত্রে অঙ্গ সংযোজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডাক্তারদের রোগী ও কিডনিদাতার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক ঘোষণার সত্যতা নিরূপণের কোনো মাপকাঠি বা উপায় থাকে না।
সাম্প্রতিক কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের কারণে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ দেশে কিডনি সংযোজন প্রায় বন্ধ। আমরা চাই সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আবার জীবন বাঁচাতে কিডনি সংযোজন চালু হোক। আমরা আগেই বলেছি, কিডনি সংযোজনের যেসব প্রতিকূলতা বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম হলো দাতা সংকট। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যা, অঙ্গ দান সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবলের অভাব ইত্যাদি তো আছেই। আমরা যদি সংকটের মূলে প্রবেশ করি তবে দেখতে পাই, কিডনি সংযোজনের মূল অন্তরায় দাতা সংকট। উন্নত দেশে মৃত ব্যক্তির অঙ্গ চাহিদার একটি অংশ পূরণ করে। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেওয়ার সব অবকাঠামো, প্রযুক্তি, লোকবল থাকা সত্ত্বেও চাহিদার তুলনায় দাতার ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে বিশ্বের উন্নত দেশেও। এ জন্য তারা জীবিত দাতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। জীবিত দাতার সংখ্যা বাড়াতে বিভিন্ন দেশে যে যে আইনের পরিবর্তন এসেছে তার আলোকে কিছু উদাহরণ ও প্রস্তাব উল্লেখ করা হলো।
১. বর্তমান আইনে দাতার পরিধি মামাতো, চাচাতো ভাইবোন, ভাগনা-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা। ২. রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও বন্ধু ও মহৎ ব্যক্তির নিঃস্বার্থ দান গ্রহণ করা। ৩. ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে স্বেচ্ছায় কিডনিদাতাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব ও অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে উৎসাহিত করা হয়। ইরানে কিডনি রোগী কল্যাণ সমিতি ও সরকারের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিডনি সংযোজন নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর করা হয়। ৪. কোনো কোনো দেশে কিডনি রোগীদের নিকটাত্মীয় মিলে সমিতি করেছেন। এদের মধ্যে মিল অনুযায়ী কিডনি বিনিময় করা যায়। ৬. চীনে প্রতি বছর ৪-৬ হাজার কিডনি সংযোজন হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি থেকে। আমেরিকায় কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যদি একটি কিডনি দান করে তবে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে নিয়ে আসা হয়। সময়ের চাহিদায় দেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আইনের সংশোধন হলে অঙ্গ সংযোজনে যে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়েছে, আশা করি তা শিগগিরই নিরসন হবে।

অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ
সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি

No comments

Powered by Blogger.