পানিসম্পদ-পানি নিয়ে ভাবনা, দুর্ভাবনা by এ কে এম জাকারিয়া

সর্বজনীন যে জিনিসগুলোর ওপর কেউ মালিকানা দাবি করতে পারে না, সেগুলো হচ্ছে—বাতাস, প্রবাহিত পানি, সমুদ্র ও সমুদ্রতীর’ (জাস্টিনিয়ান কোড)। ৫২৭ থেকে ৫৬৫ সাল পর্যন্ত রোমের (বাইজান্টাইন) সম্রাট হিসেবে দেশটি শাসন করেছেন জাস্টিয়ান। পরিচিতি ‘জাস্টিয়ান দ্য গ্রেট’ হিসেবে।


এই পুরো সময়টা তিনি ধ্রুপদি রোমান সাম্রাজ্য বলতে যা বোঝায়, রোমের সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পশ্চিম অংশকে আবার রোম সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত করার চেষ্টা করে গেছেন। এর চেয়েও বড় কৃতিত্ব, ৫২৯ থেকে ৫৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু আদেশ জারি করেছিলেন, যেগুলো ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে জাস্টিনিয়ান কোড হিসেবে। আধুনিক আইন বলতে আমরা যা বুঝি, তা গড়ে উঠছে এই কোডের ওপর ভিত্তি করে।
বাংলাদেশে ‘পানি আইন’ বলে একটি বিষয় হতে যাচ্ছে, যার খসড়া অনলাইনে দেওয়া হয়েছে, সেই সূত্রে আবার দেড় হাজার বছরেরও আগের জাস্টিনিয়ান কোডের ওপরই ভর করতে হচ্ছে। এই জাস্টিনিয়ান কোড বিবেচনায় নিয়ে সারা দুনিয়ার উচ্চ আদালত এটা মেনে নিয়েছে যে বায়ু, পানিপ্রবাহ ও সমুদ্র সর্বজনীন সম্পদ। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে তা বিক্রি বা ইজারাও দিতে পারে না। এখন দেখা যাক কী আছে আমাদের প্রস্তাবিত পানি আইনে। প্রস্তাবিত আইনের ১৪ (মালিকানা) ও ১৫ ধারায় (ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে বিদ্যমান পানির মালিকানা) নদী-নালা, জলাশয়, খাল-বিলসহ ‘দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের ভূ-উপরিস্থ পানির’ মালিকানা, ‘অবিরাম অথবা সবিরাম ঝরনা’ ভূগর্ভস্থ পানি এবং দেশের সমুদ্রসীমার পানির মালিকানা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের ওপর অর্পিত থাকার কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। আর এই পানি বণ্টনের দায়িত্ব থাকবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে (ধারা ১৭)।
পানিসম্পদ কারা কাজে লাগাতে পারবে, তার উল্লেখ আছে ২২ ধারায় (প্রবেশাধিকার অর্জন)। আর ২৩ ধারায় (নদীর কূলে প্রবেশাধিকার) বলা হয়েছে, ‘নদীর কূল, জলস্রোত, সমুদ্রের তীর ও হ্রদসমূহে এবং সরকার কর্তৃক সীমাবদ্ধকৃত কিন্তু সাধারণের জন্য উন্মুক্ত একটি এলাকার মধ্যে জনসাধারণের বিনোদন, নৌচালনা এবং মৎস্য শিকারের প্রবেশাধিকার থাকিবে। এই এলাকায় কোন ব্যক্তিকে বিনোদন, নৌচালনা এবং মৎস্য শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ছাড়া অতিরিক্ত সময় অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হইবে না অথবা কোন প্রকার নির্মাণকাজ করিতে অনুমতি দেওয়া হইবে না।’ ৩৫ ধারায় (পানি ব্যবহারের লাইসেন্স) পানি ব্যবহারের জন্য লাইসেন্সের কথা বলা হয়েছে।
এই ধারাগুলোসহ অন্যান্য ধারায় আরও এমন অনেক কিছু আছে, যা বিশ্বের সবখানে স্বীকৃত জাস্টিনিয়ান কোডের সঙ্গে বেমানান। পানির ওপর নাগরিকের যে জন্মগত অধিকার রয়েছে, খসড়া এই আইনের কোথাও এর কোনো উল্লেখ নেই। বিভিন্ন ধারায় ইজারার প্রশ্ন আছে, লাইসেন্সের প্রশ্ন আছে, পানি বিক্রির প্রশ্ন আছে, নেই শুধু পানির ওপর জনগণের অধিকারের কথা। পানিকে একটি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেই যেন এই আইনের খসড়া হয়েছে। এই আইনের খসড়াটি দেখার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্য ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম জহির উদ্দিন চৌধুরীর কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। তিনি খসড়া দেখে মন্তব্য করার জন্য সময় নিলেন। পরে বললেন, ‘একনজরে আইনটি দেখে মনে হয়েছে, পানির ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও বেসরকারি ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্যই যেন আইনটি তৈরি হয়েছে। অথচ উচিত ছিল পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষগুলোকে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আইনটি তৈরি করা।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি যা বললেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষ যাতে জনগণের বিষয়টি মাথায় রেখে সঠিক প্রকল্প নেয়, জনগণের পানি পাওয়ার অধিকার যাতে সংরক্ষিত হয়, সেটাই আইন করে নিশ্চিত করতে হবে; পানি আইনের মাধ্যমে পানি নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি নয়। এমন একটি আইন করার আগে স্থানীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে বিবেচনায় নেওয়া সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন তিনি। শেষে তিনি বললেন, কয়েক দিনের জন্য অনলাইনে দিয়ে মতামতের অপেক্ষা করে এ ধরনের একটি আইন পাস করার সুযোগ নেই। আইনটি পাস করার আগে এ নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া এবং বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার ওপর জোর দিলেন তিনি।
জহির উদ্দিন চৌধুরী যেখানে পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় আনার ওপর জোর দিলেন, সেখানে এসব কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে কী বলছে খসড়া পানি আইন? আইনটির ৯২ ধারায় (সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্য) বলা হয়েছে, ‘এই আইন অথবা বিধির অধীনে সম্পাদিত কার্যসমূহ সরল বিশ্বাসে করা হইয়াছে গণ্য হইবে এবং এইভাবে সম্পাদিত কোন কাজের ফলে কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান অথবা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে তজ্জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়/ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা/ সংবিধিবদ্ধ সংস্থা/ কর্তৃপক্ষ/ সরকারের কোন কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন আইনগত কার্যক্রম (Any Legal Proceedings) গ্রহণ করা যাইবে না।’ এই আইন আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে? জনগণের, নাকি ‘পানি বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা পর্যায়ের আমলাদের স্বার্থ রক্ষায়?

২.
পানি ব্যবস্থাপনা বা পানি নিয়ে কোনো আইন করার আগে স্থানীয় জ্ঞান বা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে পরামর্শের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন জহির উদ্দিন চৌধুরী। বিষয়টি যে কত জরুরি, তার সাম্প্রতিক একটি প্রমাণ তুলে ধরা যাক। প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৩ জুন ছাপা হওয়া একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে, ‘পঞ্চগড়ে ৭৮ লাখ টাকার পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো, নির্মাণের এক বছরেই পরিত্যক্ত’।
পঞ্চগড় সদর উপজেলায় করুম নদের ওপর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি স্লুইসগেট ওয়্যার। লক্ষ্য ছিল, পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচ-সুবিধা নিশ্চিত করা। কিন্তু দেখা গেল, এই অবকাঠামোর কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে প্রায় ৬০০ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, অপরিকল্পিতভাবে এই অবকাঠামো নির্মাণ করায় এ অবস্থা হয়েছে। প্রকল্পটি করার আগে স্থানীয় কৃষকদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হলে প্রকল্পটির এই দশা হতো না। কৃষকদের দাবির মুখে বাঁধ কেটে দিতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে আর পরিত্যক্ত হয়েছে পুরো প্রকল্পটি। মানে পুরো ৭৮ লাখ টাকাই জলে গেল।
প্রস্তাবিত পানি আইনে এ ধরনের অপরিকল্পিত কাজকে ‘সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্য’ বলে বিবেচনা করা হবে। ৭৮ লাখ টাকা কেন, রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা জলে গেলে বা জনগণ ও ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। সামনের দিনগুলোতে ‘সরল বিশ্বাসে’ এ ধরনের আরও কত প্রকল্প যে হাতে নেওয়া হবে কে জানে!

৩.
ঢাকা শহরের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে—এ খবর পুরোনো। এ কারণে ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন। কতটা নিচে নেমেছে ঢাকা শহরের পানি? ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় মাটির নিচে তিন স্তরের জলাধার রয়েছে। প্রথম স্তরটি প্রায় ৬৯ মিটার, দ্বিতীয় স্তরটি প্রায় ৩২ মিটার, আর তৃতীয় স্তরটি ৯৩ মিটারের মতো। প্রথম স্তরের পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। ঢাকায় পানির জন্য এখন গভীর নলকূপগুলোকে ভরসা করতে হচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের জন্য। প্রথম স্তর থেকে পানি উঠছে না তো পরের স্তরে নামো! সাধারণ পাম্পে পানি উঠছে না তো সাবমারসিবল পাম্প ব্যবহার করো। এভাবেই চলছে। কিন্তু নামতে নামতে কত দূর নামা যাবে? এই ভবিষ্যৎ চিন্তাটি নীতিনির্ধারকদের খুব উদ্বিগ্ন করছে বলে মনে হয় না।
মাটির নিচের পানির জলাধার প্রাকৃতিকভাবেই ভরাট হওয়ার কথা। সে পথ আমরা বন্ধ করে রেখেছি। রাজধানী ঢাকার নিচু জমি, জলাশয় —এগুলো ভরাট করে ফেলা হচ্ছে, খালগুলো তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। পাকা রাস্তাঘাট আর বাড়িঘর বানিয়ে ঢাকা শহরকে আমরা মুড়ে ফেলেছি, খালি জায়গা, মাঠ, পুকুর বা ঝিল বলে শহরটিতে কিছু নেই। বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে রিচার্জের সব পথই তো আমরা বন্ধ করে রেখেছি। ঢাকা শহরকে বসবাসের যোগ্য করে রাখার জন্য যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ করা হয়েছে, তাতে জলাশয় ও প্লাবনভূমিগুলোকে সংরক্ষণের বিষয়টি রয়েছে। এটা নিশ্চিত করা গেলে পানি রিচার্জের বিষয়টি অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে। কিন্তু ড্যাপ বাস্তবায়নের ব্যাপারেও তো ভরসা রাখা যাচ্ছে না। নীতিনির্ধারকেরা নিরুদ্বেগ থাকতে পারেন, কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা তো তা পারছি না। পানির স্তর বিপজ্জনক পর্যায়ে নিচে নেমে যাওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে কথা বলেছি আইডব্লিউএমের পানিবিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে কৃত্রিমভাবে মাটির নিচের জলাধার ভরার উদ্যোগই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বিকল্প। বৃষ্টির পানি কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই তা করা সম্ভব, এই প্রযুক্তি খুব জটিল কিছু নয়, আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। ঢাকা শহরের পাকা ছাদে বৃষ্টির সময় যত পানি জমা হয়, তার ৬০ শতাংশ রিচার্জ করা গেলেও বড় কাজ হবে। রাজউকের বিল্ডিং কোডে ভবন নির্মাণের সময় এই পানি রিচার্জের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা গেলে কাজটি খুব সহজ হয়ে যাবে। বর্তমানে সরকারি ভবনগুলো দিয়ে এই কাজ শুরু করা যেতে পারে।’ আর জহির উদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শ হচ্ছে, রাজধানীর প্রতিটি অঞ্চলে পরিকল্পনা করে কিছু খোলা জায়গা ও পুকুর বা জলাশয় তৈরি করতে হবে, যাতে প্রাকৃতিকভাবে পানি রিচার্জ হয়। দুজনই জানালেন, এই কাজ করা গেলে আরও যে বড় উপকার হবে তা হচ্ছে, শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।
পানি নিয়ে এই নাগরিক ভাবনা ও দুর্ভাবনাগুলো নীতিনির্ধারকরদের মধ্যে সংক্রমিত হবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.