বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৩৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। তারামন বিবি, বীর প্রতীক অনন্য এক নারী যোদ্ধা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ ২৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন তারামন বিবি। তাঁর নাম ছিল শুধু গেজেটের পাতায়। এখনো কয়েকজন খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায় গেজেটে। কিন্তু তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।


নিভৃত এক পল্লিতে রোগ আর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন চলছিল তারামন বিবির। ১৯৯৫ সালে প্রচারের আলোয় আসেন তিনি। তাঁকে খুঁজে বের করেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।
তারামন বিবি মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের একটি দলের সঙ্গে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালের ঘটনা তাঁর জবানীতেই জানা যাক—‘আমাদের বাড়ি ছিল রাজীবপুরের আলেকচর শংকর-মাধবপুর ইউনিয়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৪। সে সময় দেশে শুরু হলো তোলপাড়। শয়ে শয়ে মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। কে কোথায় যাচ্ছে জানি না। আমরাও পালিয়ে যাই কোদালকাঠিতে।
‘একদিন, দিন তারিখ মনে নাই, জঙ্গলে কচুরমুখী তুলছিলাম। একজন বয়স্ক মানুষ (মুহিফ হালদার), আমাকে বললেন, “তুমি আমাদের ক্যাম্পে কাজ করবা। ভাত রাঁইন্ধা দিবা। কী পারবা না মা?” সেদিন কোথা থেকে যেন একটা শক্তি পেলাম। মনে হলো, এই তো সুযোগ। মাথার ওপর রক্ষা করার মতো কেউ নাই। যার ভরসায় বেঁচে থাকব। মরতে তো হবেই। যুদ্ধ করে বাঁচার চেষ্টা করলে দোষের কী।
‘তাঁকে বললাম, “আফনে আমার মায়ের লগে কথা কন। উনি যাইবার দিলে যাইমু।” সেই সন্ধ্যায় তিনি আমার মার কাছে যান। শুধু বিশ্বাসের ওপর আমরার মা আমাকে তাঁর সাথে দেন।
‘কোদালকাঠিতেই আমার প্রথম ক্যাম্পজীবন শুরু। রান্না করা, ডেক ধোয়া। অস্ত্র পরিষ্কার করা। একদিন আজিজ মাস্টার বললেন, পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। কোনো পুরুষ যেতে পারবে না। যেতে হবে আমাকে। তাও নদী (নদ) পার হয়ে। কথাগুলো শুইনাই কইলজাটা চিনচিন করে উঠল। রাজি হয়ে গেলাম, যা থাকে কপালে! পাগলির বেশে, ছেঁড়া কাপড় পরে যেতাম শত্রুর ক্যাম্পে।
‘শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে অস্ত্র চালানো শিখলাম। একদিন দুপুর বেলা। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ক্যাম্পের আমরা সবাই ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় আজিজ মাস্টার আমাকে পিছলা গাছে উঠতে বললেন। গাছে উঠে দুরবিন দিয়ে নদীর দিকে দেখতেই চোখ বড় হয়ে গেল। নদীতে গানবোট। কিসের আর ভাত খাওয়া। সেদিন বৃষ্টির মতো গুলি সন্ধ্যা পর্যন্ত। আমি কখন যে স্টেনগান নিয়ে গুলি করতে শুরু করেছি খেয়াল করিনি। কনুই আর পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়া কত জায়গা যে পার হয়্যা গেছি। রক্ত বের হয়্যা গেছিল।
‘স্বাধীনতার পর শুরু হলো আরেক জীবন। আম্মা-ভাইবোনদের খুঁজে পেলাম। থাকার জায়গা নাই। খাবার নাই। চরে আমরা ঘর বাঁধলাম। কাজ নিলাম মানুষের বাড়িতে। চরেই শুরু হলো আমাদের জীবন। চর ভাঙে, আমাদের ঘর ভাঙে। আবার ঘর বানাই। এভাবেই চলে যায় চব্বিশটা বছর।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪। গেজেটে নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম।
তারামন বিবির পৈতৃক বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার রাজীবপুরের কাচারিপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম আবদুস সোহবান। মা কুলসুম বিবি। স্বামী আবদুল মজিদ। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে।
সূত্র: তারামন বিবি, বীর প্রতীক এবং দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ২০১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.