কে এফ রুস্তামজির চোখে ১৯৭১-মুজিব ভাই বলেছেন, ‘ভারতকে বিব্রত কোরো না’ by সোহরাব হাসান

কে এফ (খসরু ফারামুজ) রুস্তামজি। ১৯৭১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নয়াদিল্লির উইজডম ট্রি প্রকাশিত রুস্তামজির আত্মজীবনীমূলক বই দ্য ব্রিটিশ দ্য বেনডিট অ্যান্ড দ্য বর্ডার মেন অবলম্বনে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।


এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কে এফ রুস্তামজি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকেরও ব্যবস্থা করে দেন। ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে সেই সরকারের শপথগ্রহণেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর রুস্তামজি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যা ভালো মনে করো করতে পারো, তবে ধরা পোড়ো না।’ রুস্তামজি নিজেকে আড়ালে রেখেই দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করেছেন।
কে এফ রুস্তামজির আত্মজীবনীমূলক বই দ্য ব্রিটিশ দ্য বেনডিট অ্যান্ড দ্য বর্ডার মেন। সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরির ভিত্তিতে লেখা এই বইয়ে তাঁর পরিবার, স্কুল ও কলেজজীবন, প্রশিক্ষণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও কর্মজীবনে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। তিনি এই অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন লিবারেশন অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
রুস্তামজি অধ্যায়টি শুরু করেছেন ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরকালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সময়ে বাঙালিদের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা দিয়ে। তাঁর মতে, বাঙালিরা কখনোই পাকিস্তানিদের পছন্দ করত না। বাঙালি মুসলমান বাবারা ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে কন্যার বিয়ে দিলেও পাকিস্তানের মুসলমানদের সঙ্গে দিতে আগ্রহী নন। এই অপন্দের কারণটি তৈরি করেছিল পাঞ্জাবিরাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জেনারেল আকবর খান লিখেছিলেন, ‘ডান্ডা মেরেই বাঙালিদের ঠান্ডা রাখা সম্ভব।’ এমনকি তিনি বাঙালিদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি রক্ত প্রবেশ করার কথাও বলেছেন। কী ঘৃণ্য কথা? বাঙালিদের শরীরে পাঞ্জাবিদের রক্ত ঢোকানো!
এরপর রুস্তামজি ১৯৬৯-৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তাল ঘটনাবলির যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু আমরা তাঁর বই থেকে যেসব নতুন তথ্য পাই, তা হলো—ঢাকায় মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিএসএফের সদর দপ্তর থেকে গোলক মজুমদারকে পূর্বাঞ্চলের প্রধান করে কলকাতায় পাঠানো হয়। তাঁর কাছে সরকারের তিনটি মৌখিক নির্দেশনা ছিল, ‘জাতীয় স্বার্থে যা যা প্রয়োজন করা, তোমার নিজস্ব বুদ্ধি খাটাও এবং তোমার কাজের সীমা ঠিক করে নাও।’ ১০ মার্চ থেকে রুস্তামজি দফায় দফায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করেন। এসব আলোচনায় রুস্তামজি বলেছিলেন, ‘কী করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমতি দিন। আমরা একটি পথ করে নেব। এ অবস্থায় আগাম পরিকল্পনা করা যাবে না। আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
কে এফ রুস্তামজির লেখায় ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ঢাকা ও অন্যান্য শহরে সামরিক অভিযান এবং তার বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধের কথা আছে। আছে নয়াদিল্লির সরকার ও প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়ার কথা।
তিনি লিখেছেন, ‘২৮ মার্চ রোববার আমরা স্বরাষ্ট্রসচিবের বাসায় মিলিত হলাম। আমরা পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো দেখছিলাম। আমরা “কাও”-এর (আর এন কাও, গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখার প্রধান। এ শাখাটি বহির্বিভাগীয় গোয়েন্দা তৎপরতার খোঁজখবর রাখত) ব্রিফিং শুনলাম। এ পরিস্থিতিতে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা নিয়েই উদগ্রীব ছিল সেনাবাহিনী।... ৩০ মার্চ সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উত্থাপন করলেন তার শেষ কথাগুলো ছিল, “এই হাউস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক উত্থান ঘটেছে। জয় তাদের সুনিশ্চিত। এই হাউস তাদের আশ্বস্ত করতে চায়, তাদের এই সংগ্রামে ভারতের আপামর জনতার আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন আছে।”’
প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে রুস্তামজি বিএসএফকে সক্রিয় করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেন। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য ১০০ বিএসএফ সদস্যকে নিয়োগ করা হলো। তাঁর ভাষায়, ‘রণাঙ্গনে প্রবেশ করল বিএসএফ।’
এরপর রুস্তামজি কীভাবে গোলক মজুমদারের মাধ্যমে বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহযোগীদের সীমান্তে আসার খবর পেলেন, কীভাবে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন, তার বিবরণ দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদকে যখন গোলক মজুমদার কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন কিন্তু তিনি প্রথমে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। জানালেন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ো এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলো। তিনি আমাদের বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘এমন কিছু কোরো না, যাতে ভারত বিব্রত হয়, চীন উসকানি পায় অথবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের অবস্থান দুর্বল হয়।’ তাজউদ্দীন আরও বললেন, ‘তাঁকে জনগণের সঙ্গেই থাকতে হবে।’
কিন্তু গোলক মজুমদার তাঁকে বোঝালেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা তাঁকে খুঁজে বের করবে এবং হত্যা করবে। তখন তিনি কীভাবে লড়াই চালিয়ে যাবেন? তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করতে ফিরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কলকাতায় যেতে রাজি হলেন।’
রুস্তামজি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিবরণ দিলেন এভাবে: ‘গোলক আমাকে সবকিছু জানালেন। আমি কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। যখন কলকাতায় পৌঁছালাম তখন ৩০-৩১ মার্চের মাঝামাঝি একটা সময়, রাত ১২টার মতো বাজে। গোলক তাঁর চিরাচরিত হাসি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। গোলক আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, “মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে আছেন। আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?”’
‘অবশ্যই দেখা করতে চাই, এখনই চাই।’ রুস্তামজি বললেন।
এরপর তাঁর বয়ান, ‘আমরা হেঁটে জিপের কাছে গেলাম। সেখানে তাজউদ্দীন বসে ছিলেন, সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তার জন্য থাকা দুজন। আমরা তাঁকে ও আমীর উল ইসলামকে আসাম হাউসে নিয়ে গেলাম। তাঁরা গোসল করলেন। আমি তাঁদের আমার কুর্তা ও পায়জামা পরতে দিলাম। গোলক তাঁদের জন্য অমলেট করে নিয়ে এলেন। গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক রাজগোপাল আমাকে নিশ্চিত করলেন চলমান যুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদই দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমাদের জন্য তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
পরবর্তী দুই দিন তাঁরা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেন। জানেন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার বিষয়েও। তাজউদ্দীন এ পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরিভাবে ভুট্টোকে দায়ী করলেন। ইয়াহিয়া সমঝোতার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলেন; কিন্তু সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোভাব সম্পর্কে রুস্তামজি জানতে চাইলে তাজউদ্দীন সাফ জবাব দেন, ‘তাঁরা স্বাধীনতা চান। পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষ একতাবদ্ধ—এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।’
এরপর রুস্তামজি লিখেছেন, ‘গোলক তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর উল ইসলামকে নিয়ে ১ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে পৌঁছালেন। ওখানে তাঁদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিএসএফের সহকারী পরিচালক এস চট্টোপাধ্যায়। গোলক অন্য নেতাদের আনতে দ্রুতই আবার কলকাতায় ফিরে গেলেন।’
৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর উল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। শুধু ভারতীয় নেতাদের সঙ্গেই নয়, তাঁরা দফায় দফায় বৈঠক করলেন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং নয়াদিল্লিতে থাকা পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও সিরাজুল হক। নয়াদিল্লিতে সপ্তাহ খানেক থাকার পর তাঁরা ৯ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছালেন। এবার তাঁরা আরও বলিষ্ঠ, আরও প্রত্যয়ী।
তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি যাওয়ার আগে যে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছিলেন, আমরা তাও জানতে পারি রুস্তামজির লেখায়। কেননা, ‘তাজউদ্দীন সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।’ ১ এপ্রিল তিনি রাজগোপাল ও গোলক মজুমদারকে নিয়ে কৃষ্ণনগরের কাছে একটি সীমান্ত ফাঁড়িতে আসেন। সেখানে সাক্ষাৎ হয় যশোর সেক্টরের ইপিআর কর্মকর্তা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গে। আবু ওসমান তাঁকে জানান, ‘পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ নেই।’ তাজউদ্দীন আহমদ তখন বিএসএফের কর্মকর্তাদের দিকে তাকান। আর তখনই বিএসএফ মেজর আবু ওসমানকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওসমান যখন তাঁর বাহিনী নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তাজউদ্দীন মন্তব্য করেন এই যে আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ওরা ফিরে যাচ্ছে। (চলবে)
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.