পদত্যাগ করে আকরামের প্রতিবাদ

জাতীয় ক্রিকেট দলের অনুশীলন শুরুর দিনটায় বাড়তি আগ্রহ বরাবরই থাকে। ক্রিকেটারদের রিপোর্টিং ছিল সাড়ে আটটায়, যথারীতি কাল সকাল সকালই মিরপুর একাডেমি মাঠে ক্যামেরা আর সংবাদকর্মীদের ভিড়। প্রথম দিনের অনুশীলনে খুব বেশি কিছু কখনোই থাকে না।
হালকা স্ট্রেচিংয়ের পর ক্রিকেটাররা ছুটলেন জিমনেসিয়ামে। অবাক ব্যাপার, টিভি ক্যামেরাগুলো অন্য সময়ের মতো ক্রিকেটারদের পিছু নিল না। বরং সবাই ছুটলেন বিসিবি অফিসের দিকে। খানিক পর দেখা গেল, বিসিবি অফিসের প্রবেশদ্বারের মুখে সারিবদ্ধ গোটা ১৫ টিভি ক্যামেরা। স্থিরচিত্রগ্রাহকেরাও প্রস্তুত। কারণ, খবর রটে গেছে, আকরাম খান আসছেন। দিনের পর দিন ‘ওপরের চাপ’ মুখ গুঁজে সয়ে যাওয়াই যে দেশে নিয়ম, সেখানে এমন একজনের পদত্যাগ করতে আসার দুর্লভ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে হবে না!
প্রথম আলোর পাঠকেরা কাল সকালেই জেনে গেছেন, দল নির্বাচনে ক্রমাগত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক। আরেক নির্বাচক হাবিবুল বাশারের সঙ্গে আকরাম বিসিবিতে এলেন কাল বেলা ১১টার দিকে। আরেক নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন এসেছিলেন আগেই। মাঠের ভেতরে, দোতলায় অফিস কক্ষে যেখানেই যাচ্ছেন আকরাম, পেছনে সংবাদকর্মী ও ক্যামেরার মিছিল। এই ভিড়ের মধ্যেই কাজ সেরে ফেললেন। বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী দেশের বাইরে। পদত্যাগপত্রের একটা অনুলিপি দিতে হয় ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধানকেও। ক্রিকেট পরিচালনা ব্যবস্থাপক সাব্বির খানের হাতে তাই তুলে দিলেন দুটি খাম।
তাতেই ছিঁড়ে গেল প্রায় পাঁচ বছরের বন্ধন। ২০০৭ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করার পরপরই জায়গা পেয়েছিলেন নির্বাচক কমিটিতে। গত বছরের জুন থেকে প্রধান নির্বাচক। কমিটির ‘সাধারণ’ সদস্য হিসেবে প্রায় চার বছরের দীর্ঘ পথচলা, কিন্তু প্রধান হিসেবে থমকে গেলেন কেন মাত্র আট মাসেই? আকরামের উত্তর, ‘যখন প্রধান নির্বাচক ছিলাম না, তখন অনেক ব্যাপারই হয়তো আমি জানতাম না। কিন্তু আমি প্রধান নির্বাচক হওয়ার পর থেকেই কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অনেক সময়ই মনে হতো, কিছু ক্রিকেটারের প্রতি আমি অন্যায় করতে বাধ্য হচ্ছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না। এসব নিয়ে আমি বরাবরই খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। আশা করতাম, হয়তো আস্তে আস্তে ঠিক হবে। কিন্তু দিন দিন এসব আরও বেশি হচ্ছিল। এ জন্যই সরে দাঁড়িয়েছি। কারণ, এটা ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার নয়, পুরো জাতির ব্যাপার। আমার একটা সিদ্ধান্তে দেশের ক্রিকেট লাভবান হতে পারে, আবার অনেক বড় ক্ষতিও হতে পারে। চিন্তা করে দেখলাম, যেহেতু ঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না, তখন সরে দাঁড়ানোই ভালো।’
সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাঁর, সেই বোর্ড সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালই সমস্যার মূল কারণ। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নানা কারণে সমালোচিত তো হয়েছেনই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিবারই দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করাটাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন। সর্বশেষ ঘটনাটা এখন মোটামুটি সবারই জানা। আকরাম কাল আবারও জানালেন, তাঁরা ১৫ জনের দলই দিয়েছিলেন, কিন্তু সেখান থেকে তামিম ইকবালকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দেশের বাইরে থাকায় বোর্ড সভাপতির প্রতিক্রিয়া এখনো জানা যায়নি। তবে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান এনায়েত হোসেন জানালেন, বোর্ড সভাপতির নাকি মনে হয়েছে, তামিমের ফিটনেস নেই! অথচ ফিট না হলে কাউকে দল নির্বাচনে বিবেচনাই করেন না নির্বাচকেরা। আকরামও কাল জানালেন, ফিজিও ও ডাক্তারের রিপোর্ট পেয়েই দলে তামিমকে রেখেছিলেন তাঁরা! কাল আবারও ফিটনেস টেস্ট হলো তামিমের, উতরে গেলেন ভালোভাবেই!
তবে তামিম উপলক্ষ মাত্র। বারবার দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, প্রতিশ্রুতিমতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া—দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণের ফসল এই পদত্যাগ। ‘২০০৭ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই নির্বাচক কমিটিতে এলাম। ক্রিকেট ছাড়ার পর এই প্রথম সত্যিকারের ব্রেক...’—ভবিষ্যৎ গন্তব্যের প্রশ্নে একটু যেন হাহাকারের মতো শোনাল আকরামের কণ্ঠ। যেতে হলো অনেক আক্ষেপ নিয়ে। তবে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যেমন নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন, সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন নির্বাচক আকরামও।

No comments

Powered by Blogger.