কবি, কিংবদন্তি by পুলক চ্যাটার্জি

আমার মৃত্যু হলে একটাই অনুরোধ জোসনা আমার দেহ যেন ঘিরে থাকে'_ এমনই ব্যাকুল নিবেদন ছিল কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর। এ নিবেদন স্রষ্টা, নাকি প্রকৃতির কাছে ছিল তা কবিই জানতেন। তবে আজ প্রকৃতিতে পূর্ণিমা। দোলপূর্ণিমা। পূর্ণ চন্দ্র আজ অকৃপণ হয়ে জোসনা ছড়াবে অবনীতে।


সে সি্নগ্ধ কোমল জোসনা কবির নশ্বর দেহকে ঘিরে থাকবে কি-না জানি না। তবে এক অপরূপ মায়াময়তায় যে উদ্ভাসিত হবে কবির জন্মভিটা বরিশালের বাহেরচর গ্রাম, তা আমি নিশ্চিত। আর এমনই দিনে কবির সেই নিভৃত পল্লীতে আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হচ্ছে দু'দিনব্যাপী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মরণমেলা। এ মেলার আয়োজন করেছে কবির গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মৃৃতি পাঠাগার।
কেউ দেখে আর কেউ দেখে না/কেউবা মৃদু হাসে/আদর করে নেয় সে তুলে/যে জন ভালবাসে_ কবির লেখা এ ছড়া মনে পড়তেই কেন যেন মন ছুটে যেতে চাইছিল কবির সেই গ্রামে। বাহেরচর, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুগন্ধা নদী। অপরাহ্নবেলায় মোটরবাইকে বরিশাল নগরী থেকে রওনা হলাম কবিধন্য গ্রামে। সুগন্ধার বুকভরা জলের পাশের গ্রামগুলো পেরিয়ে বাহেরচরের দিকে যতই এগুচ্ছি, কেবলই মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল কবির সেই ছড়া ... আদর করে নেয় সে তুলে/যে জন ভালবাসে। কবি কি তাহলে তার গ্রাম, প্রকৃতি, নদী ও মানুষকে ভালোবেসেই এ ছড়ার জন্ম দিয়েছিলেন? কবির গ্রাম ও কবির নামে গড়ে ওঠা পাঠাগার দর্শনে বেরিয়ে বসন্তের যে মোহময় মাদকতা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল, তার উত্তরে বলতে ইচ্ছা হয়, কবি হয়তো গ্রাম, প্রকৃতি, নদী ও মানুষকে ভালোবেসেই ওই ছড়া লিখেছিলেন। নদী, প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে কবি মানসে যে ব্যাকুল কাতরতা তার বীজ বপন করা হয়েছিল হয়তো সুগন্ধা তীরের বাহেরচর গ্রামকে ঘিরেই। যে গ্রামই কবিকে কুমড়ো ফুলের লতা আর সজনে ডাঁটায় ভরা গাছ চিনতে শিখিয়েছে। খুব ছোটবেলায় কবি তার মাকে হারিয়েছেন। আর তাই হয়তো কবি তার নীরব যন্ত্রণা কবিতায় তুলে এনেছেন এভাবে ... 'আমি আমার মায়ের কথা বলছি। তিনি বলতেন, 'প্রবহমান নদী/যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে'। আবার 'মা তুমি' কবিতায় মায়ের অনুপস্থিতি বিধৃত করেছেন এভাবে ... 'মা কি শালিক পাখি? খয়েরী শাড়িতে তার হলুদ ছোপ/তারপর একদিন তিনি/ শুভ্র কাফন পরে শেফালী ফুল'। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অনুজ সহোদরা বিশিষ্ট রাজনীতিক সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান বড় ভাইয়ের স্মৃৃতিচারণ করে বলেন, 'আমরা ছোট ভাইবোনরা তাকে (কবিকে) কুট্টিদা বলে ডাকতাম। তার একটা বড় গুণ ছিল, তিনি খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। সব বয়সের মানুষ তাকে পছন্দ করত। সবসময় একটা গুরুগম্ভ্ভীর ভাব নিয়ে থাকলেও কুট্টিদা ভেতরে ভেতরে ছিলেন শিশুর মতো। তার (কবি) স্নেহাশিস মা হারানোর কষ্ট ভুলিয়ে রাখতো।' সহোদর রাশেদ খান মেনন এমপি বড় ভাইকে স্মরণ করে বলেন, 'তার স্নেহের পরশ কখনোই ভোলার নয়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন। অসম্ভব গণমুখী ছিলেন।'
কবি ও সাংবাদিক অরূপ তালুকদার আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন, তিনি কিংবদন্তির কবি হিসেবে সমধিক পরিচিতি ছিলেন। কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন শাশ্বত বাংলার ছবি; বলেছেন মায়ের কথা, পূর্বপুরুষের কথা। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মরণমেলায় অংশগ্রহণ করবেন মন্ত্রী, সাংসদসহ দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গুণীজনেরা। আয়োজন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতার। মেলায় থাকবে লোকজ ঐতিহ্যের বহুবিধ উপকরণ।
হে কবি, কিংবদন্তির কবি, প্রণামি তোমায়।

পুলক চ্যাটার্জি : ব্যুরোপ্রধান, দৈনিক সমকাল, বরিশাল

No comments

Powered by Blogger.