রাজনীতিতে চট্টগ্রামের নারীরা by একরামুল হক

দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নগরের কর্মসূচিতে নারীদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। দেড়-দুই যুগ আগে এই দুটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কর্মসূচিতে নারীদের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নারীরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শামিল হচ্ছেন।
মিছিল-সভার অগ্রভাগে তাঁদের সরব উপস্থিতি এবং ঝাঁজালো স্লোগান নেতা-কর্মীদের নজর কাড়ছে।
রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই নেত্রী দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মান্নান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক চেমন আরা তৈয়ব এবং মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির নেত্রী মাহজাবীন মোর্শেদ সংরক্ষিত আসনে সাংসদ হন। বিগত বিএনপির শাসনামলেও সংরক্ষিত আসনে রোজী কবির ও নূর-ই-আরা সাফা সাংসদ হন। রোজী কবির কেন্দ্রীয় বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নূর-ই-আরা সাফা কেন্দ্রীয় মহিলা দলের সভানেত্রী।
আওয়ামী লীগের সাংসদ হাসিনা মান্নান বলেন, ‘আমাদের রক্ত আর রাজনীতি যেন একাকার। আমার স্বামী এম এ মান্নান গণপরিষদ এবং সংসদ সদস্য ছিলেন। তেমনি আমার বড় ভাই নুরুল ইসলাম চৌধুরী বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ভাই ও স্বামী একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ওই চেতনাকে আমরা লালন করছি।’
রাজনীতিতে নারীদের ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে সাংসদ হাসিনা মান্নান বলেন, ‘এখন অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারীদের কল্যাণে নারীনীতি প্রণয়ন করেছেন। এই নীতি বাস্তবায়িত হলে সর্বস্তরে নারীদের উপস্থিতি বা ভূমিকা আরও বাড়বে।’
বিএনপির সাবেক সাংসদ রোজী কবির এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি সাংসদ হন। এখনো রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন তিনি। চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতিতে নারীদের ব্যাপক সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকাও রাখেন তিনি।
সাংসদ মাহজাবীন মোরশেদ দেশের বাইরে আছেন। তাঁর স্বামী মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবারে আমাদের জন্ম। আমার বাবা সেকান্দর হোসেন মিয়া মহানগর জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি দুবার সাংসদ নির্বাচিত হন। আসলে আমাদের রক্তের মধ্যে মিশে গেছে রাজনীতি। এর ধারাবাহিকতায় আমার স্ত্রী মাহজাবীন জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হন।’
চট্টগ্রাম নগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন হাসিনা মহিউদ্দিন। তবে তাঁর স্বামী সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের রাজনীতিতে যতটা অপরিহার্য, নিজেকে সে পর্যায়ে তুলে ধরতে পারেননি হাসিনা মহিউদ্দিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনীতিকের মতে, ‘বড় বৃক্ষের ছায়ায় হারিয়ে গেছেন তিনি।’
নারীনেত্রীরা জানান, জাতীয় সংসদ কিংবা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জয়ী নারী প্রতিনিধিদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং সালিস-বিচারের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহি বেশি করতে হয় বলে নারীনেত্রীদের জনপ্রিয়তা সেভাবে কমছে না। এ কারণে বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত সেই নেত্রীরা ঘুরেফিরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের সাধারণ কাউন্সিলরের তুলনায় নারী কাউন্সিলরেরা যেকোনো সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দিতে পারেন বলে ভুক্তভোগী নাগরিকদের অভিমত।
নগরের লালখান বাজারের বাসিন্দা আবুল হাসনাত জানান, নারীনেত্রীরা যেকোনো বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। মানুষের সুখে-দুঃখে মিশে যান তাঁরা। সালিস-বিচারে দ্রুত সমাধান দিতে পারেন। তাই মহিলা জনপ্রতিনিধিদের জনপ্রিয়তা কমছে না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে ১৪ জন নারী সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাঁদের মধ্যে রেহেনা বেগম, ফেরদৌস বেগম (মুন্নি), শাহ নূর বেগম, আফরোজা বেগম, শাহেদা কাশেম ও জোবায়দা নার্গিস তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পরপর দুবার নির্বাচিত হন মনোয়ারা বেগম, আরজু সাহাবউদ্দিন, রেখা আলম, আঞ্জুমান আরা, বেবি দোভাষ ও ফেরদৌস আরা তাহের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেত্রী জান্নাতুল ফেরদাউস। প্রথমবারই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও সন্তুষ্ট নয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিনজন নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তাঁরা বলেছেন, পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের সমান অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অধিকার আদায়ের জন্য নারীদের আরও বেশি ত্যাগী হতে হবে। এজন্য শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।
চট্টগ্রাম নগর মহিলা আওয়ামী লীগের দপ্তরবিষয়ক সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেহেনা বেগম বলেন, ‘২০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নারীদের সম্পৃক্ততা অনেক বেড়েছে। তবে তা সন্তোষজনক নয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে পেছনে ফেলে রাখা হচ্ছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন বোঝায় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীকে রাখতে হবে। গঠনতন্ত্র মানা হলে নারীরা আরও বেশি রাজনীতিতে সক্রিয় হবে।’
রেহেনা আরও বলেন, ‘একজন নারীনেত্রীর হাত ধরে আমি রাজনীতিতে এসেছি। তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কীভাবে করতে হয় সেটা ওই নেত্রী আমাকে শিখিয়েছেন। তাঁর নাম নিলুফার কায়সার। তিনি বেঁচে নেই। তবে আমরা এখনো নিজেদের অধিকারের সিকি ভাগ আদায় করে নিতে পারিনি। এজন্যে আমাদের আরও অনেক সংগ্রাম করতে হবে। ঘাম ঝরাতে হবে। তাই মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে।’
রেহেনার বক্তব্য সমর্থন করেছেন নগর মহিলা দলের সভানেত্রী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো পুরুষের হাত ধরে রাজনীতিতে আসিনি। আমার বড় তিন বোন আমাকে উদ্ধুদ্ধ করেছেন। তাই রাজনীতিতে আসা। এসেই দেখি পুরুষেরা যা বলেন, তা-ই সবকিছু। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। এজন্যে নারীদের আরও বেশি হারে রাজনীতিতে আসা উচিত। কারণ রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব।’
আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘মর্যাদার দিক থেকে যে সমান অধিকারের কথা বলা হচ্ছে তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন স্তরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে বৈষম্য কমে আসবে।’
জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম কলেজে একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় বাম ধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সহপাঠীরা আমাকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে আসতে উদ্ধুদ্ধ করেছে। সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ও নারীর অধিকার আদায় সম্ভব।’
নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘মেয়েরা রাজনীতিতে আসছে। আরও ব্যাপকহারে আসা উচিত। দেশ ও সমাজের নীতিমালা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নে পুরুষের সঙ্গে তাঁদেরও ভূমিকা রাখতে পারে। আর নীতি নির্ধারণে মেয়েদের ভূমিকা খুবই নগণ্য। এজন্যে রাজনীতিতে আসা মেয়েদের শিক্ষা ও জ্ঞান বাড়াতে হবে, যাতে তাঁরা ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে।’

No comments

Powered by Blogger.